হার মানি তাই বারে বারে
মহাশ্বেতা দাস
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে ছোট থেকেই কিছু কথা মাথার ভেতর জাঁকিয়ে বসে তার মধ্যে অন্যতম একটি "জিততে হবে।" স্কুলের রেজাল্টে জিততে হবে, আবৃত্তি, অঙ্কনের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জিততে হবে, খেলার মাঠেও জিততে হবে। সবসময় সবার বেলায় এই "জিততে হবে" টা যে ভালো ফল দেয় এমনটাও নয় অন্তত জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা তাই বলে। এরপর পাঠকেরা হয়তো মনে মনে ভাবতে শুরু করেছেন- "তবে কি এবার থেকে ছেলে মেয়ে কে হেরে যেতে শেখাবো!" না, আজ সেই মনস্তাত্ত্বিক আলোচনায় যাবো না। বরং আজ হেরে যাওয়ার সুখের স্মৃতির ঝুলি থেকে কিছু রেখে দেবো এখানে।
তখন পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামের একটি শতবর্ষ প্রাচীন বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। বাস রাস্তা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতরে মোরাম রাস্তা হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। মাঝে মধ্যে একটা দুটো ভ্যান রিক্সা (টলি) থাকে বটে তবে সবসময় পাওয়া যায় না। একদিন স্কুল ছুটির পর বিকেলে লাল মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছি… অনুভব করলাম আমার বাম হাতের একটা আঙ্গুল কে যেন মুঠো করে ধরেছে। তাকিয়ে দেখি স্কুলের পোশাক পরা পিঠে লাল রঙের একটা ব্যাগ নিয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র তন্ময়।
" কী রে তুই! বাড়ি যাবি?"
মুখটা ওপর দিকে তুলে... "ও ম্যাডাম তোমার ঘর কোথায় গো? তোমাকে রোজ এদিকে যেতে দেখি... তাই আজ তোমার সাথেই যাবো।"
"আচ্ছা চল। কিন্তু আমি তো তাড়াতাড়ি হাঁটবো, তুই ছোট... এত তাড়াতাড়ি কি পারবি আমার সাথে?"
"উঃ ম্যাডাম, তুমি কিচ্ছু জানো না। আমি মোরামের ওই গুলি গুলোর উপর এক পা চেপে আর একটা পা তুলে দিলেই এমনি চাকার মত অনেকটা চলে যাবো।"
"সে কি! পড়ে যাবি তো!!"
না না পড়বো না। ঐ জন্যেই তো তোমার হাতটা ধরে আছি। এই দেখো.... কাল তুমি যখন রিশকাটায় উঠেছিলে, রিশকা চলতে শুরু করতেই আমি পিছনে ঝুলতে ঝুলতে চলে গেলাম। তুমি দেখতে পাও নি।"
"আর কখনও ঐ ভাবে যাবি না। যেদিন মনে হবে আমার সাথে সামনে এসে বসবি।"
".... ঝুলতে ঝুলতে গেলে পয়সা লাগে না গো। বসে গেলে লাগবে। আমার কাছে বাস ভাড়া দু টাকা থাকে।"
"সে লাগুক পয়সা। আমি দিয়ে দেবো। তবু ওই ভাবে ঝুলবি না।"
"তুমি দেখছি ঠিক আমার মায়ের মতো কিছুই জানো না। আমি পড়বো না গো..."
কখন যে বাস রাস্তায় এসে গেছি... বাস এসে গেল। দৌড়ে উঠে গেল তন্ময়। আমি বাসে উঠতেই... "ও ম্যাডাম এদিকে এসো। তোমার জন্য জায়গা রেখেছি গো।"
দুটো স্টপেজ পরে নেমে গেল তন্ময়। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ওর সরলতার কাছে হার মেনে বললাম," সত্যিই রে... তোর মায়ের মতো আমিও অনেক কিছুই জানি না!"
মেয়ে তিন বছরের, সবে নার্সারি স্কুলে যেতে শুরু করেছে। সেদিন আমি ছুটি নিয়েছি তাই ওর স্কুল ছুটির পরে বাড়ি নিয়ে আসবো বলে অন্যান্য মায়ের মতোই গেটের সামনে অপেক্ষা করছি। ছুটির ঘন্টা বাজতেই একে একে পুতুল গুলো ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে আসছে আর ওদের চোখ গুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের মুখ।
"মা ঐ রাস্তাটা দিয়ে চলো।"
"এই রাস্তা টা কী করলো!! তাছাড়া আইস্ক্রীম দোকান তো ঐদিকে নয়!"
"আজ জীবন থানদা খাবো। তুমি তো জানোই না... তাই তোমাকেও দেব।" চাকা লাগানো একটি দোকান গাড়ি তে করে বরফ কুচি গ্লাসে দিয়ে তার ওপর লাল, সবুজ রঙের সিরাপ দিয়ে বিক্রি করছে।
"আমার ম্যাঙ্গো তাই গ্রীন। তোমার জন্য ব্ল্যাক।"
"কেন আমি ও সবুজ টা খাই না!"
" ওটা কালা কাততা.… তুমি তো জানোই না। "
বললাম "সত্যিই! জানতাম না তো।" মনে মনে বললাম তোদের সাথে থাকলে এমনিই জীবন ঠান্ডা থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা ক্লাসে সেদিন। পাঠ্য কবিতার কয়েক লাইন -
"...বলে এলাম আমি
আবার আসব,
আমার ঘরের দরজা এখন
সবুজে সবুজ।"
তৃতীয় বেঞ্চে বসে থাকা সুশোভন - " ম্যাডাম, জানেন কেন গাছের পাতার রঙ সবুজ হয়! কারণ পাতায় ক্লোরোফিল থাকে। বিজ্ঞানের স্যার বলেছে।"
বললাম, "তাই নাকি! না রে জানতাম না তো!!"
এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা রীতেশ এবার ভাবছে ....আমি কম যাই কি! তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে -- " গাছ তার পাতাতেই খাবার তৈরী করে। তাই পাতাকেই গাছের রান্নাঘর বলে। এটাও তো জানোনা তুমি!" মুখ টা এমন... যদি একবার ম্যাডাম বলে দেয় যে এটা জানতাম। তাহলে সুশোভনের কাছে ওর প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে।
আমি বললাম, " তাই! গাছ পাতাতেই রান্না করে নেয়! হাঁড়ি, কড়া, খুন্তি... কিচ্ছু লাগে না!?"
গোটা ক্লাস হো হো করে উঠলো... "ম্যাডাম আমাদের বিজ্ঞান বই টা তোমাকে একদিন দেবো।" দেখতে দেখতে ওরা বড়ো হয়ে গেল। আমার আঙ্গুল ধরে হাঁটা তন্ময় যখন নবম শ্রেণী.... দেখি আমি ওর কাঁধের নীচে! একদিন বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যে যার মতো উচ্চ শিক্ষার জন্যে পা বাড়ালো। তখনও এসে গেছে আরও কচিকাঁচার দল।
একদিন ট্রেনের কামরায় জানালার পাশে বসে বাইরের প্রকৃতি দেখছি। "ম্যাডাম কোথায় যাবেন? আমাকে চিনতে পারছেন! আমি সুদীপ্ত আপনার ছাত্র।"
"ও.... হ্যাঁ মনে আছে। তুমি কোথায় যাবে? বসো।" মুখোমুখি সিট নিয়ে বসলো। ট্রেন চলেছে পাল্লা দিয়ে চলেছে ছাত্র - শিক্ষক কথাবার্তা।
"ম্যাডাম শীতকালে আগের মতোই আপনার গলার সমস্যা হয়! আমি কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সঙ্গে আমার ফোন নম্বর। অসুবিধে হলেই আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, বলে দেবো কী করণীয়।"
একাদশ শ্রেণীতে সুদীপ্ত যখন পড়ে তখন বাংলা ক্লাসে ওদের পড়িয়েছিলাম ডক্টর আবিরলাল মুখোপাধ্যায়ের লেখা "শব্দের আশীর্বাদ, শব্দের অভিশাপ" প্রবন্ধ।
তারপর মাঝে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে আজ সেই সুদীপ্ত একজন নাক- কান- গলা বিশেষজ্ঞ।
আজ সত্যিই তো সুদীপ্তদের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নেওয়ার আছে।
পুজোর ছুটিতে হোস্টেল থেকে মেয়ে বাড়ি এলে জিজ্ঞেস করলাম --
"জিনিসপত্র ঠিক করে রেখেছিস তো। কঙ্কাল টা! ওটা কোথায় রাখলি?"
"উঃ..... মা,তোমাকে কতবার বলেছি যে ওটাকে skeleton বলে।"
কী করে জানবো বল্... তোর মতো ডাক্তারি পড়িনি তো!"
"মা জানো.... আগামী বিশ্বকাপে প্রথম কারা মাঠে নামবে? মেসি মোট কত গুলো ম্যাচ খেলেছেন.... মা তুমি জানো?"
না রে!... এত কিছু তো জানিই না। শুধু জানি শীতের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে বড্ড মন কেমন করে তোর, তোদের জন্যে। কবে তোরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে জয় করে বাড়ি ফিরবি... আমরা অপেক্ষায় থাকি। তোদের কাছে এই হেরে যাওয়ার ছোটো ছোটো এই স্মৃতির টুকরো গুলো গুছিয়ে রাখি সযত্নে। অপেক্ষায় থাকি আবার কবে কোন অছিলায় হার মানবো তোর কাছে!
.......…………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - নিজস্ব
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment