Saturday 5 November 2022

মহাশ্বেতা দাস এর গল্প // ই-কোরাস ৮১

 



মহাশ্বেতা দাস এর গল্প

ভুবন মনমোহিনী

 

          

"ক্রিং ক্রিং...."  দম দেওয়া টাইমপিস ঘড়িটাতে এলার্ম বেজে উঠলো। 

"উঃ আওয়াজ টা এতো জোরে...."  কোন রকমে মশারির বাইরে হাত বের করে এলার্ম টা বন্ধ করে দিল রমিতা। শান্তি শান্তি! 


ঠাকুমার মুখে শুনেছে বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের সময়ে যে শান্তি জল ছিটানো হয়, সেই বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটায় ভর করেই নাকি শীত উঁকি দিয়ে যায়। তারপর কালীপুজো যেতে না যেতেই বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে গুচ্ছের সোয়েটার, টুপি, মোজা আর বিছানায় বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে লেপ, কম্বল। শীত ভোরে ঘুমটা বড্ড মায়া জড়ানো! চোখ থেকে যেতেই চায় না!! এলার্ম বন্ধ করে পাশ ফিরে সবে শুয়েছে... মা এসে - " রমি, উঠে পড় মা। এক্ষুনি কাকু ডাক দেবে। মর্নিং ওয়াকে যাবি তো!"  

প্রতিবছর শীত পড়লেই সৌমেন বাবু কয়েকজন কচিকাচাদের নিয়ে মর্নিং ওয়াকে যান। সঙ্গে যায় আট বছরের রমিতা আর কাছে পিঠের জনা কয়েক। 


রমিতার মা প্রমিলাদেবী ঘুম জড়ানো রমিতাকে তুলে সোয়েটার, টুপি, মোজা পরিয়ে তৈরী করে দেন। ভোর চারটার সময় বাড়ির বাইরে পা দিয়ে, চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা.... গলির মোড়ে দেবদারু গাছটার পাতা থেকে টপ টপ করে শিশির পড়ছে। কুয়াশা ঠেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে  যেতে যেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল রমিতা... একটা দুটো তারা উঁকি দিচ্ছে। যেন রমিতা কে বলছে - "আমরাও জেগে আছি তোমার জন্য।" শীতলা মন্দির পেরিয়ে গেলেই মল্লিকদের বাড়ি। জানালার সামনে ডাক দিতেই বেরিয়ে এলো নীপা, ঋজু আর টুসি..... ওরাও যাবে। দশ বারো পা গেলেই শিলাবতি নদীর উপর ভাসাপুলের সিঁড়িতে ঘুমোচ্ছে তিন চারটে কুকুর। পায়ের শব্দ পেয়েই ওরই মধ্যে একটা..... "ভুক্" করে উঠতে না উঠতেই সবাই জড়াজড়ি করে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো কাকুর পিছনে। সৌমেনবাবুর হাতে কুকুর তাড়ানোর জন্য একটি করে গাছের ভাঙা ডাল থাকে.... " নে চল চল, আর কিছু করবে না। পুলের এপারের সিঁড়ি থেকে ওপরের সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে না.... মাঝখানে দৃষ্টি শক্তি কে রুদ্ধ করে আছে সাদা অন্ধকার। নৌকার দু একটা আলো যেন ধ্রুব তারার মতো পথ দেখাচ্ছে.... "এসো ভয় নেই! আমরা আছি।"  শিশির পড়ে পুলের কাঠের তক্তা গুলো ভিজে গেছে, তাই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। শিলাবতী নদীর উপর এই ভাসাপুল সেই ব্রিটিশ আমলের। মোটা মোটা কাছি দিয়ে বাঁধা নৌকার উপর কাঠের পাটাতন বিছিয়ে এই পুন্টুন (ভাসমান) ব্রিজ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। ভাসাপুল দেখাশোনার জন্য সবসময় লোক নিযুক্ত থাকে, তারা তখনও নৌকায় ঘুমোচ্ছে। ওপারের সিঁড়িতে ছেঁড়া কম্বল গায়ে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে আছে পুতু ক্ষেপি... ওর বাড়ি কোথায় কেউ জানে না। এই সিঁড়িতেই শীত, গ্রীষ্ম প্রায় সারা বছরই ভিক্ষে করে কাটায়।সম্বল বলতেএকটি লাঠি আর পুরানো একটা বাটি। বাম দিকে একটু এগিয়ে গেলেই পোষ্ট অফিস চক্। তিনমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে হুইসেল বাজাতেই সামনের দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে...." যাচ্ছি কাকু.....!" বেরিয়ে এলো সুজাতা আর ওর ভাই গৌতম। সুমনার বাড়িটা রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। বাঁশির শব্দে চুইংগাম চিবাতে চিবাতে বেরিয়ে এলো। 


গৌতম গোল গোল চোখ করে.... "কী রে সুমনা একা এলি যে! বোন কোথায়?" "ওকে আজ ঘুম থেকে তোলাই গেল না।"  চোখ ঘষতে ঘষতে সুমনা উত্তর দিল। 


টাউন লাইব্রেরী পেরিয়ে হাই স্কুলের কাছ দিয়ে শিলাবতির পাড় ধরে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়ক পেরিয়ে যখন কুশপাতার বাঁধে পা পড়লো... পূব আকাশ কুয়াশা ঠেলে একটু যেন হাসছে। একটা দুটো শিউলি ফুল তখনও টুপ টাপ করে পড়ছে। ওদের সাথে সঙ্গী হয়ে শিলাবতি নদী ও কী যেন একটা বলতে চাইছে! যেটা শুধু রমিতাই বোঝে। রমিতার সাথে শিলাবতির বন্ধুত্ব বোধ হয় এভাবেই শুরু। শীতের ভোরে নদীর তীরে কুয়াশা ঠেলে যতই এগিয়ে যায় - কত কী যে চোখে পড়ে রমিতার! নদীর জলে দড়ি দিয়ে বাঁধা লম্বা লম্বা বাঁশ গুলো ভেলার মত ভাসছে। নদীঘাট গুলো তখনও জনহীন।তাই ঘাটের সামনের জল খুব স্বচ্ছ। তির তির করে বইছে। শীত বেশী লাগলে গৌতম একটা উপায় বের করেছে। হাতে হাতে ঘষা আর হাততালি দেওয়া। তবে হাততালি টা সব সময় হাতে হাতে না হয়ে মাঝে মাঝে সমবয়সী সুমনার পিঠে পড়ে যায়! কী করা যাবে.... হাত টা বড্ড চুলকায় যে! আর ছিঁচ কাঁদুনে সুমনা অমনি-"ভ্যাঁ!" 

      

ছুটতে ছুটতে নিমতলার মাঠ। একটা পোড়া গির্জা। রমিতার ইতিহাস বইয়ে থাকা ছবির মতো। মাঠে কয়েক পাক ঘুরেই এবার ফেরার পালা। কুয়াশাও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নীপা, ঋজু বা টুসির মাফলার - চাদরের মতো। পূব আকাশে লাল আভা। পুকুর গুলোতে কচুরিপানার নীল ফুল গুলো খিল খিলিয়ে হাসছে আর বলছে..." তোমাদের এখনও শীত লাগছে! বাঁধের দু'পাশে ধুতরা ফুল শিশির সিক্ত হয়ে আছে। আকন্দ ফুলও নেহাৎ কম নয়। কালবৈশাখীর ঝড়ে যেমন আম কুড়ানোর ধুম লাগে আম খাওয়ার জন্য নয় বরং অনেক বেশী কুড়ানোর আনন্দে... শীতের ভোরে শিশির সিক্ত ধুতরা ফুল, আকন্দ ফুলও নেহাৎ তোলার আনন্দেই তুলতে ইচ্ছে করে। সুজাতা ঘাসের আগা থেকে তুলে নেয় ছোট্ট হলুদ রঙের ফুল.... কে যেন বলছিল এটা নাকছাবি ফুল!


ধোঁয়া উঠছে নদী তীরের ইট ভাটা থেকে। সারি সারি কাচা পাকা ইট। জল আনছে, ইট বইছে, মাটি গুলছে পাশের ঝুপড়ি গুলোতে থাকা কিছু উদবাস্তু মানুষ। ওদের ছোট বাচ্চা গুলো ছেঁড়া জামা পরে ধুলো মেখে খেলছে। পাশে একটা চায়ের গুমটিতে আঁচের উনুন জ্বলছে। সামনে বাঁশের বেঞ্চ পাতা। ফেরার সময় এখানেই একটু বসে চা খায় সৌমেনবাবু। কাঁচের জারে থাকা খাস্তা বিস্কুট,কেক।  বিশেষ করে ওই গোল কেক গুলো, মাঝে একটু মোরব্বা টুকরো। সুমনা চারদিক থেকে খেয়ে খেয়ে শেষে ওই টুকরো টা খাবে, এটা আবার গৌতমের ঠিক সহ্য হয় না। সুমনার ভাগে কি বড়ো কেকটা পড়েছে তবে? নাহ্.... পাশাপাশি রেখে মেপেছিল... একই তো!


নীপা আর সুজাতা গল্পে মশগুল। ঋজু টুসিকে নিয়ে পাশের কলে জল খাচ্ছে। রমিতা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ধুলো মাখা বাচ্চা গুলোর দিকে। একটা বাচ্চা এগিয়ে এল, আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে বিস্কুটের জারটা। 

"এদিকে আয়। বিস্কুট খাবি?" - রমিতা হাত নেড়ে ডাকলো। "তোর মা কোথায়?"

ছোট্ট হাতটা তুলে দূরে ইটভাটার কাজেরত এক মহিলা কে দেখালো বাচ্চাটা। প্রথমে একটা বিস্কুট তারপর আরও একটা - "একটা তোর আর একটা ভাইকে দিবি। মনে থাকবে?"  রমিতার প্রশ্নে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো আঁচের উনুনের ধোঁয়ায় মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যাওয়া ছোট্ট মানুষটা। 

: তোর মায়ের নাম কী?

 ধোঁয়ার আড়াল থেকেই লাজুক হাসি মুখটা দেখা গেল!

: মায়ের নাম-মা।

…………………........


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614


No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...