মণিজিঞ্জির সান্যাল এর গল্প
ভেসে আসা রোদটুকু
- দুটো ভিক্ষে দেবে মা।
- আমার কাছে খুচরো নেই গো।
-- আচ্ছা মা। কপাল ঠেকিয়ে চলে গেল শান্তভাবে, কোন গালিগালাজ না করে।
অদ্ভুত শান্ত মুখটা! অনেকদিন দেখেনি জয়া। মেয়েকে নিজের পাশে বসিয়ে পড়াচ্ছিল। ছোট্ট মেয়ে রিমঝিম সবে ক্লাস টু- তে পড়ে। জানলার ধারে এক চিলতে রোদের আশায় মা, মেয়ে শীতের দুপুরে এই বিছানার ধারটুকুতে আশ্রয় করে প্রতিদিন। শীতের ছুটিতে এই রোদটুকু যে বড় আরামের।
রিমঝিম বলে ওঠে "ওই যে মা দেখো ঐ ভিখিরিটা আবার আসছে এদিকে।"
মেয়ের কথা শুনে জয়া বলে " ছিঃ এমন বলতে আছে রিমঝিম?"
-- ও স্যরি মা, ঐ বুড়িটা আসছে।
-- না, একদম না।
--- তাহলে?
-- দিদুন বলো বা দিদা বলো।
রিমঝিম চোখমুখ বড় করে বলে দিদুনরা বুড়ো হয় তাই না মা? মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেলে জয়া। তারপর বলে সবাই একদিন বুড়ো হবে। আমি বুড়ি হবো, তোমার বাবাই বুড়ো হবে। মায়ের কথা শুনে রিমঝিম মা'কে জড়িয়ে ধরে বলে "না না তোমরা কখনো বুড়োবুড়ি হবে না, কক্ষনো নয়।"
কথা বলতে বলতেই ওরা দুজনে লক্ষ করল ঐ বয়স্ক মহিলা পরের দুটো বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসছে। কেউ ভিক্ষে দেয়নি বোঝা গেল। রিমঝিমদের জানলার সামনে আসতেই জয়া হাত নাড়িয়ে বলল " ও মা একটু দাঁড়ান। "
"মা!"
থমকে দাঁড়াল সেই বৃদ্ধা। এইভাবে তো কেউ কখনো কথা বলে নি। সবাই তো তুমি, তুই বলেই সম্বোধন করেছে। তারপর "মা!'
এক মুখ বিস্ময়ে স্মিত হেসে দাঁড়ালো বৃদ্ধা ভেসে আসা রোদটুকুর মধ্যে, যেন আরামের প্রলেপ ঐ রোদটুকু।
দশটা টাকা মেয়ের হাতে দিয়ে জয়া বলল "যাও দিয়ে এসো।"
রিমঝিম মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে এক ছুটে বাইরে গিয়ে টাকাটা দিতেই ঐ বৃদ্ধা দু'হাত ভরে আশীর্বাদ করে বলল "ভালোভাবে পাশ করো মা, আর মায়ের কথা শুনে চলো।"
ঘাড় নাড়িয়ে রিমঝিম বলল " কোথায় তোমার বাড়ি?"
বৃদ্ধা হাসতে হাসতে বলল "ঐ ফুলেশ্বরী বাজারের কাছে। "
জয়া জানলার কাছে এসে মুখ বাড়িয়ে বলল
"আমার মেয়েকে ভাল করে আশীর্বাদ করবেন। আপনি আমার মায়ের মতো।"
বৃদ্ধা হেসে বলল " তুমি তোমার মাকে কি আপনি বলো? "
জয়া হালকা হাসে। রিমঝিম বলে ওঠে " আমার মায়ের মা' তো ঠাকুরের কাছে চলে গেছে সেই কবেই। "
--- আহারে আর বলোনা সোনা, তোমার মায়ের কষ্ট হচ্ছে। এই তো আমি আছি। সোনা মা আমার, মন খারাপ করো না। এই পৃথিবী থেকে সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। দুনিয়ার সবকিছুই যে শুধু মায়া। পৃথিবীতে আমার বলে কিছু নেই মা। সব-ই ঈশ্বরের খেলা।
চমকে ওঠে জয়া, একী ! এই কথাগুলো ছোটবেলায় মা-ও বলত। একজন ভিখিরির মুখেও এতো সুন্দর কথা!
-- তোমার নাম কিগো? রিমঝিম খিলখিল করে হেসে জানতে চায়।
---আমার নাম বুড়িমা।
---বুড়িমা! এ আবার নাম হয় নাকি?
-- সত্যিই আসল নামটা ভুলে গেছি সোনা। এসো তোমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করি। আর শোনো মায়ের কথা শুনবে কিন্তু আবার এক-ই কথা বললাম।
রিমঝিম ঘাড় নাড়িয়ে এক ছুটে ঘরে এসে মায়ের পাশে বসল। জয়া বৃদ্ধার মুখের দিকে ভালো করে তাকাতেই বুকের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। কি অদ্ভুত মায়া জড়ানো চোখদুটো , এই বয়সে কত কষ্ট , স্বামী না থাকলে তো আরো কত কষ্ট। কি সুন্দর মুখশ্রী , মায়ের মুখটা মনে পড়ল বেশি করে। বাবার আগেই তো মা চলে গেল। সবকিছু বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল জীবন থেকে। কেন যে এমন শূন্যতা কাজ করে সব সময় কে জানে।
জয়া নিজে মাতৃত্বের স্বাদ পায়নি, একটা বাচ্চার জন্য আত্মীয় স্বজন, এই সমাজ কেউই তাকে ছেড়ে কথা বলেনি একসময়। উঠতে বসতে কতো প্রশ্ন কতো কৌতূহল। শুভ অনুষ্ঠানগুলোতে তাকে সযত্নে সরিয়ে রাখা হতো। সন্তান না হবার জন্যে মানুষের উপেক্ষিত চোখগুলোকে আজও ভুলতে পারে না। চোখে জল এসে যায়, হঠাৎ জয়া বলে ওঠে "আচ্ছা তোমার ছেলে নেই? "
-- আছে তো? চার ছেলে।
--চার ছেলে! আর মেয়ে?
--এক মেয়ে, বিয়ে হয়ে গেছে।
-- কোথায় থাকে মেয়ে?
----রাঙ্গাপানি।
---আর ছেলেরা?
--ছেলেরা আমার সাথেই থাকে।
--মানে! তোমার নিজের বাড়ি আছে?
--হ্যাঁ, ছোট কাঁচা বাড়ি মা।
--সে হোক কিন্তু বাড়িটা তো তোমার নিজের , ভাড়া বাড়িতে তো থাকো না?
--না মা।
---কে করেছে বাড়িটা?
---আমার স্বামী।
---স্বামী কবে মারা গেছে?
-- সে তো অনেক বছর হল মা।
কথা বলতে বলতে জয়া আর রিমঝিম একটা থালাতে সকালের জলখাবারের তৈরি পরোটা, সবজি আর বেগুনভাজা খেতে দেয়। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সেই বৃদ্ধা। বারান্দার এক কোণে একটা টুলে আরষ্ট হয়ে বসেছে। মাটিতেই বসতে যাচ্ছিল কিন্তু এই ঠান্ডায় রোদহীন বারান্দায় জয়া আর রিমঝিমের জোরাজুরিতে টুলেই বসেছে শেষ অবধি। রিমঝিম খুব খুশি নতুন অতিথি পেয়ে, আর পড়তে হবেনা। কৌটো থেকে দুটো বিস্কুট আর জল আগেই এনে দিয়েছিল। গল্প তখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। দেশ স্বাধীনের আগে কিভাবে এখানে এসে পড়েছিল। ছোটবেলার জীবন থেকে বিবাহিত জীবন। তারপর স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর কি নিদারুণ পরিস্থিতিতে পাঁচ ছেলে মেয়েকে বড় করেছে। যে টুকু টাকা পয়সা ছিল তাই দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। কারো কাছে হাত পাতেনি কখনো। মেয়ে সুন্দর সংসার করছে।
-- ছেলেরা বিয়ে করেছে?
--আমার চার ছেলেই বিয়ে করেছে মা।
--একই বাড়িতে থাকো, ছেলেরা দেখে না কেন?
-- দেখে তো মা।
--ছেলের বউরা কেমন?
--বউমারাও খুব ভালো। আমার বউমারা খুব যত্ন আত্তি করে। ছেলেরাও খুব ভালো আমাকে খুব মানে।
ছেলেরা যত্ন আত্তি করে! তোমাকে খুব মানে!
অবাক হয় জয়া, বলে কি এই মহিলা! তাহলে এই শীতে এই বয়সে হেঁটে হেঁটে লাঠি নিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করতে কেন বেরিয়েছে?
মনে মনেই বলে কথাগুলো।
--- বাড়িতে একসঙ্গেই থাকি মা। ছেলেরা মাছ মাংস খায়, আমি তো ওসব খাই না , তাই ...
---তাই কি ?
--- তাই নিজের খাবারটুকু নিজেই চালিয়ে নি।
-- প্রতিদিন ভিক্ষা করো?
--- না মা, মাসে তিন - চার দিন ভিক্ষা করি, এর বেশি পারি না। একদিন যা পাই তাই দিয়ে অনেক দিন চলে যায়। অনেক সময় মাসে দুদিন ভিক্ষে করি। একা মানুষের আর কত লাগবে বলো।
-- খাও তো এক মুঠো ভাত।
-- সেই তো মা। দুদিন যা পাই তাই দিয়েই অনেক দিন চলে যায়। ছেলে বৌমারা ওদের রান্নার সবজি দেয় প্রতিদিন। একটু চাল ফুটিয়ে নেই। চালের কতো দাম তাই না মা ? এই যে আজ তুমি কত কিছু খাওয়ালে।
--- কোথায় কতোকিছু খাওয়ালাম? আমার তো রান্নাই হয়নি এখনো। একটু ডাল আর সবজি ...
--- মা এ যে অমৃত , কতোদিন পরে এতো সুন্দর রান্না খেলাম, কতো কিছু খেলাম। পান্তা ভাত খাই মাঝে মধ্যে, শরীর নেয় না আজকাল। রাতে যেদিন ভাত খাই, তার থেকে একটু রেখে দি জল দিয়ে পরের দিন হয়ে যায় ।
-- এই যে বললে বৌমারা সবজি দেয়।
মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেই কষ্ট পায় জয়া।
'অজান্তে কেন কষ্ট দিলাম এই বুড়ি মাকে।' হয়তো এই কল্পনার জালবুনেই তার একরকম আত্মতুষ্টি বা বেঁচে থাকার রসদ।
-- আজ সারাদিন কিছু খাব না, পেট একদম ভরে গেছে মা। একদিনের চাল আমার বেঁচে গেল যে।
জয়ার দুচোখ জলে ভরে ওঠে, মায়েরা বুঝি এমনই হয়। এই তো ছোট্ট পেট, তার জন্য লাঠি নিয়ে বেরিয়েছে নিজের একমুঠো খাবারের জন্যে। নিজের স্বামীর তৈরি বাড়িতেই নিজের সন্তানের কাছে কি চূড়ান্ত অবহেলিত। তবুও সন্তানকে কিছুতেই হেয় করেনি। এমনকি ছেলের বৌদেরও নয়। পৃথিবীতে এই মায়েদের মূল্য কে দেবে?
জয়া অবাক হয়ে বলে "তোমার বাড়ি বললে ফুলেশ্বরীতে।"
--- হ্যাঁ মা।
--তো এই এতোদূরে তুমি কেন ভিক্ষা করতে আসো?
---বাড়ির সামনে তো ভিক্ষা করা যায় না। ছেলেদের সবাই চেনে, ওদের খারাপ লাগবে, ওদের ছোট করতে পারি না মা।
--- আর মেয়ে? তোমার মেয়ের কাছে যাও না?
--- এই বাড়িতে জামাইকে আনতে পারি না একদিনের জন্যেও। আমি কি করে যাই মা?
সত্যিই তো আজকের দিনে এখনো জামাইকে আদর -যত্নে রাখার চল আছে এই সমাজে। যেখানে জামাই আদর নেই, সেখানে জামাইএর বাড়িতে গিয়ে থাকবে কি করে শাশুড়ি? যতোই পাঁচ সন্তানের জন্ম দিক, যতো ই মাতৃত্বের অহংকার থাকুক, বৃদ্ধ বয়সে মা যে সন্তানের কাছে অস্তিত্বহীন।
কথায় কথায় বৃদ্ধা বলে তার জীবনের টুকরো কথা।
ছোট ছেলের চাকরির সময় জমানো সত্তর হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তা না হলে ছেলেটার চাকরি হতো না। মেয়ের বিয়ের সময় দুকাঠা জমি বিক্রি করায় ছেলেরা রাগে মায়ের সাথে কথা বলে না। কিন্তু কি করার ছিল এই মায়ের? ছেলেদের সাহায্য পাবে না সে ভাল করেই বুঝেছে, ভাল পাত্র হাতছাড়া করলে মেয়ের বিয়ে দিতে অসুবিধে হবে। তাই তো নিজের যেটুকু সম্বল তাই দিয়েই নিজেকে নিঃস্ব করে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরেছে। মেয়েও সেই লজ্জায় দাদা বৌদিদের দিকে তাকাতে পারে না।
---- এই জন্যেই তুমি একা হয়ে গেছ।
জয়া কথাটা বলতেই খেয়াল করে বৃদ্ধার চোখে জল। অবাক হয় জয়া। অবচেতনে কতো কথাই তো বলে ফেলেছে আজ। ইস কেন বলল এতোদিনের জমানো কথাগুলো। না বললেই ভাল হতো। মাতৃত্ব সে যে ভীষণ কঠিন।
বৃদ্ধা চলে গেল একসময় লাঠিতে ভর করে। চোখের সামনে ভেসে উঠল ফেলে আসা অনেকগুলো বছরের স্মৃতি। রিমঝিম ঘরে আসার আগের সেই সব মানুষের মুখ। মা' না হলে জীবনের অনেক কিছুই যে অপূর্ণ থেকে যায়। একটা সন্তানের জন্য মায়েদের কতো আকুতি মিনতি। জয়ার কেন জানি কোনো আকুতি ছিল না। বরং তিন বছরের রিমঝিমকে পেয়ে নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে।
" আচ্ছা মা ঐ দিদুনকে কেন ভিক্ষা করতে হয়?"
জয়া চমকে ওঠে, কোনো কথা বলে না। মনে মনে বলে বয়স হলে পৃথিবীর সব মায়েরাই যে একপ্রকার অবলা জীব, তবুও তো এই বুড়ি মা চলতে পারে কোনোরকমে টেনে টেনে, কথা বলতে পারে নিজের মতো কিন্তু রিয়ার মা তো দীর্ঘ দুবছর ধরে বিছানায় শুয়ে আছে, ফ্যালফ্যাল করে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। একটুকরো আকাশও দেখতে পায় না কখনো। মেঘেদের লুকোচুরি খেলা, কালবৈশাখীর দাপট কিচ্ছু টের পায় না আর। বদ্ধ ঘরে একা একা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি'ই বা করার আছে। অথচ রিয়ারা প্রত্যেকে উচ্চশিক্ষিত। ডাক্তার আর ওষুধের টাকার ভাগাভাগি করতে করতে শেষে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে নিজেদের জীবনের স্বার্থে। একদিন দেখতে গিয়েছিল ছোটবেলার বন্ধুর মাকে কিন্তু আর যাওয়া হয়নি । চোখে দেখা যায় না সেই কষ্ট । ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে থাকা মানুষটির চোখের জল নীরবে মুছে দিয়েছিল সেদিন জয়া। বোবাকান্না সঙ্গী করে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। তারপর থেকে নিজে নিঃসন্তান বলে আর দুঃখ হয়নি। অনাথ মেয়েটিকেই তাই বুকে জড়িয়ে বড় করতে চেয়েছে। নামও রেখেছে মেয়ের রিমঝিম।
---- মা তুমি কাঁদছ কেন? তুমি কখনো বুড়ি হবে না। একদম এমনটাই থাকবে। হ্যাঁ বলো, বলো না?
মেয়েকে জড়িয়ে জয়া বলে উঠল " তাই হবে সোনা।"
হঠাৎ সামনের সোজা রাস্তাটার দিকে চোখ গেল। ধীরে ধীরে অনেকটা পথ চলে গেছে বুড়িমা। রিমঝিমও মায়ের সাথে নীরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে লাঠিভর করে ঝুঁকে ঝুঁকে চলে যাওয়া সেই মায়ের দিকে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সেই দৃশ্য কিভাবে কখন ...
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - নিজস্ব
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment