গুরুপদ মুখোপাধ্যায় এর কবিতা
অনুসন্ধানী চোখে
আমি যখন শিলায়ের পাড়ে বাতিঘরে অন্ধকারে
ক্লান্ত বাতাস উদ্বায়ী হয় মেঘেদের সাথে মিশে।
নতজানু ঈশ্বরী আমার! লজ্জার পাহাড় ভেঙে ভেঙে
আকন্ঠ ডুবে পাঁকে; পাপ ক্লেদ তাপে
হরপ্পার মৃত হাড়ের দেয়াল ; স্নানাগার
চিতার আগুনে পুড়ে উঠে আসে পাললিক
শিলা; জীবাশ্মের হাড় ; মৃত মানুষের মুখ ;
নতমুখ তোল এবার ঈশ্বরী আমার!
বিন্দু বিন্দু ঘাম তোমার আঁচলে।
কাটা দেয়ালে খলামের কুচির মত
খুঁটে খুঁটে তুলে আনা আরব্ধ অশুচি
সব ছুঁড়ে দিতে চাই আদমের বনে
জ্বলছে রেনফরেস্ট ফুসফুস জুড়ে আজ
আবারো দাঁড়াও ঈশ্বরী সম্মুখে আমার!
তোমার গন্ধে শুদ্ধ হোক কমন্ডলু; চিরাগ
অসুর দৈত্যের মুখ চাতকের শিলালিপি পড়ে ;
পুড়ে যাক পাঁকের সংসার।আঁধার খুঁড়ে
তোমায় খুঁজি পলাশ ও চন্দনের বনে।
……………..
উদ্বাস্তু
প্রত্যেক মানুষের ভিতর একটা উদ্বাস্তু আছে
পায়ের শিকল ভেঙে যে পাখির দল উড়ে যায়
তারা জানে শিকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা ;
তবু্ও গভীরে রয়ে যা,য় শিকড়।
শুকোয়না; পচেনা; সূত্রগুলি মহাকর্ষের টানে!
শিকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণা আমার নেই
আছে? কিজানি হয়তো শিকড় জানে
তারা ছড়িয়ে পড়ে স্বপ্নময় শরীরে
যারা সব ফেলে জীবন বাঁচাতে এককোপে
শিকড় কাটে! তারা কি " মেঘে ঢাকা তারা "?
তারা কি " আর জন্মের ঘর" কে জানে?
কিন্ত তারা জানে শিকড় কাটার গল্প; কলোনি জীবন;
গান বাঁধার গল্প; তারা ছেঁড়া মেঘ জানে।
পরিব্রাজন ভিতরে গজগজ করছে শিকড়
কোথাও যেন চিত্রকে রেখেছে বেঁধে।
ঘর বাঁধে কপোত-কপোতী; ঝড়ে
উড়ে যায়; আবার খড়কুটো বয়ে এনে এনে...
থেমে নেই! যন্ত্রণার কোলাহল; শব্দ বাঙাল
কিন্তু শরীরের ভাষা তো এক; প্রেম ...
আবার ঘরও ছুঁয়ে আছে শিকড়ের টানে।
আমিও এক উদ্বাস্তু তাই!
………………
অস্থিকলস
ভেঙে ভেঙে শিলাই এর চর
ভাঙন থেকে তুলে আনি জংলীরাত
রূপের গহ্বর ছেনে অস্থির মুগ্ধতা; অরণ্যভাতি।
সারা শরীর জুড়ে সুরেলা বন্দিশ
হে কাকেশ্বর! কাকিনীর কালোদেহে
ঢেলে দিলে স্তব্ধনিশি; শব্দবীজ; ঝিঁঝি ডাক।
একক যাপনে কাটে কত রবীন্দ্ররাত
ধুয়ে যাওয়া রাত্রির ধবল কণাগুলি
কুড়িয়ে রাখি কড়িবাক্সে; শূন্য জোনাকি।
শুয়ে থেকো অমল তামস অস্থিরতা ছুঁয়ে
ছেয়ে দিও জলরাতি; রাধার বাসর
নূপুরের ঢেউ গুনে সতরে কালোচোর।
পড়ে থাকে অন্ধবাঁশি; নক্ষত্র নাভিশ্বাস
কেয়ূর কুন্ডলে অন্ধবিলাপ
ভেঙে যায় জোৎস্নামিনার ঐশ্বর্য কুহকে।
বিদ্যাপতি গেয়ে উঠে ; জ্বলে ঝাড়বাতি
উথলে উঠে শৃঙ্গার ঢেউ মুগ্ধ অছিলায়
মরমী চণ্ডীদাস গান বাঁধে রাতের প্রান্তিকে।
সেজে উঠে কবিতার অস্থি কলস।
…………..
শতায়ুরা
আমার চোখের উপর দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ
আমার কর্ণিয়ায় বসে
দোল খাচ্ছেন জীবনানন্দ।
মঞ্চ তৈরি অর্জুন! এবার লক্ষভেদ; পদ্মাক্ষি।
হে দ্রুপদ নন্দিনী! তোমার প্রধান সখা তৃতীয় পান্ডব
চিত্রাঙ্গদা তোমারও?
পার্থ; তোমার আঁতের সখা মথুরারাজ; যমুনার যুবরাজ
চোখের জল যমুনার কূল ভেসে ভেসে যায় মথুরায়
ধুয়ে যায় লালতিপ; চোখের কাজল; পুরুষ চন্দ্রাবলী জোৎস্নায়;
কালেশ্বর! মহাকালের ঐশ্বর্যবিলাপ
দুর্বার গিঁটগুলএঁকেবেঁকে ঝরাপাতা বনে।
আমি আঁকি; ভগ্নজানু মন; রক্তাক্ষি
পাতার ভিতর বেড়ে ওঠা রুদ্রাক্ষ আজানুলম্বন
ছুঁয়ে থাকেন রবীন্দ্রঈশ্বর!
অনসূয়া; প্রিয়ম্বদা।
পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রামলাইন; ছাতিমতলা; জোড়াসাঁকো
ক্যানভাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে
একান্ত যাপন।
রবীন্দ্র জীবনানন্দের শতায়ুরা ...!
……………….
নক্ষত্র জলসায়
রোদদৃষ্টি খুঁটে খুঁটে খায়
নরম ঘাসের শরীর; শিশির
ফুল ও অলিদের নিবিড় মুহূর্তের
ছবিগুলি বীজ হয়ে ফোটে; হরিৎ জোৎস্নায়
নারীরা ছড়াতেছ ফুল; মেঘেদের ঝিরিঝিরি
পাখি দম্পতি ঘনিষ্ঠ সন্ধ্যায়।
কথা কয় পরস্পর!তারপর!
উড়ে যায় অন্য ঠিকানায়
ছড়াতে থাকে বীজ;মাটি ও মেঘের
একান্ত যাপনে জেগে ওঠে কিশলয়;
'নরম নদীর' দেশে; বনে জোৎস্নায়
ছুটে যায় পাখির ডানায়
তেপান্তরী মরু হাওয়া;
শুয়ে থাকে 'নম্রনীল'জানালায়।
মরালীও ডুব দিতে দিতে আড়চোখে দেখে নেয়
মরালের মতিগতি!এই জঙ্গলেই হরিণীর ডাক শুনে
ঘুম ভেঙেছিল চাঁদের ;- আসেনি হরিণ;নরম নদীরা
কোন ষোড়শী ছড়ায়নি ফুল ;লেপ্টে চন্দনের তিপ
তপ্ত হাওয়া ঘুরে ঘুরে তার চুলে দোলা দিয়ে যায়।
রাজহংসী!সরিওনা ওষ্ঠ -অধর!
চাঁদ ডুবে চলে গেলে নক্ষত্র জলসায়
শিলাই এর চোখে ভেসে যাবে
জঙ্গল ;দিনলিপি; পাখিদের সংসার;
সঙ্গম দেউল;আঁধারের ধারাপাত
রোদ আর গাছেদের নৈঃশব্দ্য সাঁতার।
…………….
মানচিত্র
জটিল আবর্তের স্হানাঙ্কে ঢুকে পড়ছে তপ্ত
মরুহাওয়া; ছুঁতে চায় সমান্তরাল অবয়ব।
চাঁদ দেখে লাঙ্গল ফলায় সাজানো নাঙেলির স্তনের অর্ঘ্য;
কেঁপে ওঠে আজানের আজানু; শিখার কর্তন তুলসীতলায়;
এখন ধর্মপাল! ধর্মগুরু ঢুকিয়ে দিতে চাইছে
হাজারের ফেলে আসা পিরামিডে;
নদীও সরে যায় উষ্ণতা খেয়ে খেয়ে।
হে ত্রিকাল! খুঁজে দেখ তোমার ছেলেবেলা মেয়েবেলা
নিরন্ন দুপুরের আমতলার সাথীকে।
গুহাচিত্র ;মানচিত্র; হিংস্র দাঁত!ধান জমি থেকে
কেঁপে ওঠা ধানশিস ছুঁয়ে থাকো বাতাস শরীর;
বুনতে হবে বীজ; উপপাদ্য; সম্পাদ্য;
সংবর্তনী; সঞ্জননী; সালোকসংশ্লেষ; সিনথেসিস।
ইথারে ছড়ানো মানচিত্র ;রেজাল্টটার্ন সংকেত;
একটা আস্ত দেশ।
………………
তীরভূমি
দাঁড়িয়ে আছি রণভূমে
ক্লান্ত এ তীরভূমি
প্রত্ন সঙ্কল্প সমিধ পান্ডুলিপি
ভাসিয়ে দিয়েছি ঘূর্ণিতে
মাতলার ঢেউ থেকে উঠে আসে কামিনী কাঞ্চনের ক্লেদ পাপ তাপ
বিসর্জনের ঘট ফুল মালা ভেসে যায় মোহনায়!
একটা নদী হতে চেয়েছিল
বারবার গেছে উৎসের কাছে
দাঁড়িয়ে থেকেছে; গ্রহণ করেনি ঝর্ণা।
ফিরে এসেছে বারবার!
অর্থ আর নষ্ট শরীর গ্রহণ করেনি সে
ফসিলের লীনতাপ বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে ঝরে।
নদী শরীর চায়
গ্রহণ করেনা নষ্ট শরীর
আজ নষ্ট বাংলার মাটি
পাপও পেরিয়ে যাচ্ছে মোহনার দ্বার।
………………..
সম্পর্ক
ভেঙে যায় সম্পর্কের নিগড়; দোয়াব জমিন
গাছ শিকড় চায়; শিকড় মাটি চায়
গভীর রাত জল খোঁজে ওম; ভেঙে যায় ঐহিক
তবু বাঁচে বিশ্বাস; প্রজন্ম শ্বাস
ভাঙতে ভাঙতে জমছে সভ্যতার লাশ।
চুরি হয়ে যাচ্ছে সোনা, তোমার শরীর
ধর্ষণের দিনরাত্রি!
মরণফাঁদ চারদিকে, জানি প্রতিশোধ নেবে একদিন।
দায় ছিল প্রতিবাদ প্রতিরোধের। দিইনি ডাক…
পারিনি! আমরা কবিরা পারিনি!
তোমার আঁচলের খন্ড খন্ড ছড়িয়ে ভূমিজা।
দিয়েছো অনেক, ছড়িয়েছ জন্ম শিকড়
নেমখারাম হরণ করেছে তোমায়!
আজ তুমি ধর্ষক বন্দী শিলাই।
……………..
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - নিজস্ব
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment