Saturday 13 August 2022

সন্দীপ দত্ত এর গল্প // ই-কোরাস ৬৯

 



সন্দীপ দত্ত এর গল্প

কপাল

আনাজের ব‍্যাগটা তখনও ঠিকঠাক ভর্তি হয়নি যাদবের। স্ত্রী ললিতার পইপই করে কান কামড়ে বলে দেওয়া কাঁচা কুমড়ো নেওয়া হয়নি। নিজের পছন্দের ঘিয়ে মৌরলা নেওয়াটাও বাকি। হঠাৎ ভরা বাজারের মাঝখানে নীলকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

নীলকান্তবাবু মানেই  পরিপাটি করে আঁচড়ানো কলপ লাগানো চুল,চেহারায় অদ্ভুত এক দ‍্যুতি আর পাটভাঙা পোশাক। এতদিন এমনটাই দেখে এসেছেন যাদব। এতদিন মানে গত আট বছর। আজ সেই মানুষটিকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারলেন না তিনি। চুলে কলপের কালো রঙ আছে ঠিকই,তবে বড়ই অবিন‍্যস্ত। শরীর জুড়ে চিন্তার ছাপ। পরনের পোশাকও পাটভাঙা নয়,খানিক ময়লাটে। শত ভাঁজ পরা।

"কী ব‍্যাপার নীলকান্তবাবু,আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? শথীর টরীর ঠিক আছে তো?" জিজ্ঞেস করলেন যাদব।

"হ‍্যাঁ দাদা,শরীর ঠিক আছে। আসলে......"

"কী হয়েছে নীলকান্তবাবু?"

"আচ্ছা যাদবদা,আপনি অ‍্যাস্ট্রোলজিতে বিশ্বাস করেন? ঐ যারা হাত টাত দেখে? কপালে আতস কাচ ধরে ভাগ‍্য বলে দেয়?"

"না। সে তো আপনিও করেন না। কেন বলুন তো?"

"হ‍্যাঁ,এতদিন করতাম না। আসলে হয়েছে কি........-বলতে বলতে আবার থমকে গেলেন নীলকান্ত।

"কী হয়েছে বলবেন তো!"

"না মানে,গত সোমবার এই ধরুন সকাল সাড়ে দশটা এগারোটার দিকে একটা জরুরি কাজে মার্কেটের দিকে যাচ্ছি,হঠাৎ একজন মধ‍্যবয়েসি লোক,কপালে যার এত্তোখানি সিঁদুর আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা,এসে আমার পথ আটকে দাঁড়াল। বলল,আর দু'চারদিনের মধ‍্যেই আমার নাকি শনির দশা শুরু হবে। ঐ যে শনির সাড়ে সাতি না কী যেন বলে না,ওইটা। এখন সাড়ে সাত বছর ধরে আমার খারাপ সময় যাবে।আর্থিক ক্ষতি হতে পারে,দুর্ঘটনায় পড়তে পারি,আরও অনেক কিছু।"

"বলেন কী মশাই! এ তো ভারি মুশকিল! সাড়ে সাত বছর!"

"হ‍্যাঁ যাদবদা। ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি। রাত্রে ঘুম হচ্ছে না। সারাক্ষণ খালি টেনশন।"

"লোকটা রেমিডি নিয়ে কিছু বলেনি? না,মানে সমস‍্যা থাকলে তার তো সমাধানও থাকে। তেমন কিছু.......।এই যেমন ধরুন,অমুক যজ্ঞ করলে ফাঁড়া কেটে যাবে। কিংবা ঘরোয়া কোনও টোটকা..........। কিছুই কি বলল না নীলকান্তবাবু?"

"হ‍্যাঁ,বলল উপায় একটা আছে। যদি ওটা মেনে চলি,কপালের ফের কেটে যাবে।"

"কী সেটা?"

"আমাদের এই সাড়ে সাত বছরের জন‍্য স্থান পরিবর্তন করতে হবে। দূরে কোথাও চলে যেতে হবে আমাদের।"

"সেকি! আর আমাদের  মানে? বাড়ির সবাইকে?"

"হ‍্যাঁ দাদা। লোকটা বলল,আমার কপাল মানেই বাড়ির সকলের কপাল। বউ,ছেলে,নাতি নিয়ে সংসার করি দাদা। ঝুঁকি কি নেওয়া যায়?"

"সবাই যাবেন? তাহলে বাড়িটা?"

"সাড়ে সাত বছর সময়টা তো কম নয় যাদবদা। এতগুলো বছর বাড়িটা তালাবন্দি করে রাখলে শেষে যদি ভূতের বাড়ি হয়ে যায়! তাই ভাবছি বাড়িটা বিক্রি করে দেব।"

"বাড়ি বিক্রি করে দেবেন!"

"তাছাড়া আর উপায় কী?"

"তা কোথায় যাবেন নীলকান্তবাবু? পাহাড়ে,না সমুদ্র? না মানে,কোথায় গেলে শনির প্রকোপ থেকে বাঁচবেন?"

"বুঝতে পারছি না দাদা। একদম বুঝতে পারছি না। দেখি।"

নীলকান্তবাবুর কথা শুনে গম্ভীর হলেন যাদব।

বাকি বাজারটা ঐ গাম্ভীর্য নিয়েই করতে হল যাদবকে। তবে খুব কষ্টে। কোনওরকমে বাড়ি ফিরে বাজারের ব‍্যাগটা স্ত্রীর হাতে দিয়েছেন কি দেননি,নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে হাসিতে ফেটে পড়লেন যাদব। হাসতে হাসতেই ললিতাকে বললেন,"এবার নীলকান্তবাবুও অভিনয় শুরু করেছেন গিন্নী। আর পালাবার পথ নেই। একেই

 বলে,কপালের নাম গোপাল।"

"আশ্চর্য! তুমি এত হাসছ কেন? আর আগডুম বাগডুম কী সব বকছ?" ললিতা বললেন।

"না গিন্নী,জামাই রোহিত আমাদের ঠিক তথ‍্যই দিয়েছে। অবশ‍্য ওর খবর যে সত‍্যি হবে,আমি জানতাম। বিডিও সাহেব বলে কথা। দিন কয়েক আগে ওর মুখেই শুনেছিলাম,রাজ‍্যজুড়ে অবৈধ শিক্ষকদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে। যারা কোনও পরীক্ষায় না বসে শুধুমাত্র লাখ লাখ টাকা দিয়ে চাকরি পেয়ে বছরের পর বছর বেতন নিয়েছে,কোর্ট রায় দিয়েছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এবং শুধু চাকরিই তাদের যাবে না,ফিরিয়ে দিতে হবে এত বছর ধরে নেওয়া বেতনের পুরো টাকাটাও। রাজ‍্যের বিভিন্ন জায়গাতেই  এখন এইসব অজুহাতগুলোকে সম্বল করছে মানুষ। হয় গ্রহগত কারণ দেখিয়ে বিক্রি করছে বাড়ি,নয়তো কোনও ডাক্তারের পরামর্শকে কাজে লাগিয়ে বিক্রি করছে। যারা ওভাবে চাকরি পেয়েছে,তাদের বুক এখন কাঁপবে। প্ল‍্যান করে বাড়ি বিক্রি করে আগেভাগে তাই রেডি হয়ে থাকা। আর বাড়ি বিক্রি ছাড়া তো উপায়ও নেই। এতগুলো মাসের বেতন........। তিরিশ পঁয়ত্রিশ লাখ তো হবেই।"

"তুমি জানলে কী করে নীলকান্তবাবুর ছেলে পীযুষ টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছে?"

"তানাহলে হঠাৎ করে বাড়ি বিক্রি করতে যাবে কেন? অমন সুন্দর রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি।"

"ছিঃ! কী কেলেঙ্কারি বলো তো!" এবার মুচকি হাসলেন ললিতাও।

"সব চাইতে কষ্ট লাগছে এই সমাজটাকে দেখে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো এইসব দেখেশুনে কী শিখবে? শিক্ষকতার পেশাটাকে আর সম্মান করতে পারবে তারা?"

কথাগুলো বলতে বলতে স্নানে গেলেন যাদব। দশটার মধ‍্যে দোকানে যেতে হবে তাঁকে। কর্মচারি ছেলেটা আজ আসবে না। তার বোনের বিয়ে।

ঠোঁটে হাসির দাগ নিয়ে আয়েশ করে বাজার থেকে আনা কাঁচা কুমড়ো কাটতে বসলেন ললিতা।

...................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ - নিজস্ব

ঠিকানা -সুরতপুর,  দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১

কথা - 9434453614







No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...