Thursday 22 October 2020

e-কোরাস ৪০ // কবিতা সংকলন ; বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা

 





কবিতা সংকলন ; বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা

সম্পাদনা - অঞ্জন দাস ও বিপ্লব ভূঞ্যা

আলোচক - অসীম ভুঁইয়া 


সুদূরের শিলান্যাস ও মেধাবী অন্বেষণ 

"but it is not merely on account of its subject that this poem deserves attention; it is full of poetic merit and its descriptions are often exceedingly beautiful." 

                          ---- Athenoeum


কোনো কবিতা সংকলনে যখন নামের ভার-পরিধি ও মানের উৎকর্ষতা একীভূত হয়ে যায়, 'আকাশ আর দিকচক্রবাল'  মিলনের মন্ত্রে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে, 'কাগজ ও কালির বন্ধুতা'  সুদূরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে, তখন সেই কবিতা ফুলেরা এক একটি পাপড়ি ছড়িয়ে পৃথিবীময় তপস্যার অধ্যয়নে মুক্তি ও মোক্ষকে পাখির চোখ করে নেয়। কাব্য- বোধের, সময় - বোধের যে শব্দভেদী তির  গোটা সমাজ, সাময়িকতা তথা সময়ের উত্তরণকে  মুহূর্তেই মুক্ত ( open Art)  করে দেয়, সে অর্জুনের শৈশব শিক্ষা নয়, সে তো একলব্যেরই স্বশিক্ষার মহিমময় ইশারা...  

"বিষ পাড়ার হাঁড়িকথা": কবি অঞ্জন দাস ও বিপ্লব ভূঞ্যা এর  যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত কবিতা সংকলনটির প্রতিটি কবিতায়, প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি চিত্রকল্প, প্রতীকে বা বৈচিত্র্যের নির্মাণ - বিনির্মাণে প্রবাহিত যেন স্বর্গীয় অলকানন্দা।  আর আমাদেরও "হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে"।

এই সময়ের অন্যতম চর্চিত ও স্বনামধন্য কবিরা এই সংকলনে স্থান করে নিয়েছেন  স্বমহিমায়।  ৯৪ জন কবির ৯৪  টি কবিতা এই সময়ের একটি প্রামাণ্য দলিল উপহার দিয়ে গেল আপামর বাংলা কবিতা পাঠকদের। সংকলনের প্রথম কবি শ্যামলকান্তি দাশ তার "সাঁকো" কবিতায় দুটি সিস্টেমকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছেন। "একেক দিন সন্ধ্যাকে দেখি, আর/ একেক  দিন দুচোখ ভরে আরতিকে।" সাঁকো বানাবার কৌশল রপ্ত করার সমস্ত কাঁচামাল মজুত আছে, শুধু তাকে অনুসন্ধান  করে নিতে হবে । আরেক স্বনামধন্য জনপ্রিয় কবি মৃদুল দাশগুপ্ত , ঝড়ের চিত্রকল্পে প্রবহমান সত্তাকে ধরতে চেয়েছেন । শংকর চক্রবর্তী সেলাই মেশিনের প্রতীকে অদ্ভুত মেলবন্ধনের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। তবে আক্ষেপের সুরও  ফল্গুনদীর মতো তার অন্তর - স্রোতে চিরভাস্বর। সুধীর দত্ত তাঁর কবিতায় এক  অমর পংক্তি  রচনা করলেন- "যথাযথ বিনিয়োগে কবি/ ঈশ্বরের সমতুল্য, প্রতিস্পর্ধী;" রাহুল পুরকায়স্থ, মলয় গোস্বামী, সমর দেব , সুধারঞ্জন বাগ, ব্রতী মুখোপাধ্যায়রা কেউ ধর্মহীন পথের সন্ধানে বেরিয়েছেন, কেউ মৃত্যু- ঘন্টার ইঙ্গিতের  মাঝে আয়নাকে খুঁজে পেয়েছেন, অথবা কেউ ধারালো সময় পেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবার কেউ শব্দের ভেতর জীবন উপলব্ধি করেছেন। মাসদুল হক, প্রভাত মিশ্র, বিকাশ গায়েন, দিশারী মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা বন্দোপাধ্যায় ,বিকাশ চন্দ, দেবাশিস প্রধান, তৈমুর খান, শুভ্রশঙ্খ পাত্ররা তাদের  কবিতায় কখনও শ্লেষ বা  দুরূহ যন্ত্রণায় সময়কে ধরতে চেয়ে ভবিতব্যের এক একটি অনুমান রচনা করেছেন। নদীকবি সুনীল মাজির কবিতায় ঐতিহ্যের ধারাবাহিক পথক্রমায়   ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের হৃদয় নির্মিত হয়েছে।" ... তুমি বিস্তৃত এক আকাশের/ সঙ্গে পরিচিত হলে/ বৃক্ষ মাঠ জলাশয়রা তোমার বন্ধু হয়ে উঠল: এই বন্ধুত্ব অযুত হাজার বছরের ভারতবর্ষ ।" সুজিত দাশের কবিতায় মায়াজন্ম থেকে বিদায়ের কথা উঠে এসেছে। সুদীপ্ত মাজি " চিত্রকল্প"  নির্মাণের মধ্য দিয়ে সলিল- সমাধির মোক্ষ লাভে হৃদয় আকর্ষণের যবনিকা ফেলে দিয়েছেন।  সুবীর সরকার, দিশা চট্টোপাধ্যায়, রিমিদের কবিতায় নীল আকাশ ও নীল সমুদ্রের মিলনক্ষণে যেন কাব্যবোধের ও মুহূর্ত -চিহ্নের অদ্ভুত সাযুজ্য গড়ে উঠেছে।নাস্তিক কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর "সংজ্ঞার  বিপরীতে কে বা কারা যেন দাঁড়িয়ে থাকে।" আশিস মিশ্র, পার্থজিত চন্দ, গৌতম ভট্টাচার্য, রাজিব ঘোষাল, অরুণ ভট্টাচার্য, মাসুদার রহমান, কৌশিক বর্মণ, লক্ষীকান্ত মন্ডল: এদের কবিতায় মাটির গন্ধ,সাম্যের ভাবনা,  আলোর কথা ও ধূসর মেঘের ছবি চিত্রিত হয়েছে সুনিপুণ দক্ষতায়।  সম্পাদক কবি অঞ্জন দাস "পুরুষ নদী"  কবিতাটিতে  আগুনের নেশায়, আগুন খেয়ে, আগুন নদীতে প্রবাহিত হয়ে সাগর সঙ্গমে বিলীন হতে চাওয়ার দর্শন লিখে দিয়ে গেলেন । অন্য সম্পাদক বিপ্লবের "কথাজন্ম " কবিতায় কবি  কথারূপ  প্রতিশ্রুতির পাত্রে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের সুরা পান করতেই ব্যস্ত। কিন্তু সবশেষে আবার উৎস রেখায় প্রত্যাবর্তন... 

সংকলনটিতে  প্রবীনদের সাথে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিমান, প্রবল সম্ভাবনাময় তরুণ কবিদের স্থান দেওয়া হয়েছে। আমরা গৌতম মাহাতো, তাপস বৈদ্য, মঞ্জির বাগ, শ্রীতনু  চৌধুরী, অভিনন্দন মুখোপাধ্যায় ,রাজেশ্বরী ষড়ঙ্গী খুকু ভূঁইয়া, অরিন্দম প্রধান, বেবি সাউ, দুঃখানন্দ মণ্ডলদের  অসামান্য সম্ভাবনাময় কবিতার পংক্তি বিন্যাস দেখতে পাই। দুঃখানন্দ মণ্ডলের কবিতায় যন্ত্রণা ও তাকে সয়ে যাওয়ার অনন্য প্রয়াস লক্ষণীয়।" পরিচিত ব্যথা ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যায়।"  কিন্তু তিনি মনে মনে আবার বলে ওঠেন, "সত্যি কি তাই?" এছাড়াও সুদীপ্তা মাইতি,  শৈলেন চৌনী, তনুশ্রী কার্তিক, সৌমাল্য গরাই , মৃণালকান্তি, তাপস দাস, পল্লব গোস্বামী, অতনু রায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সুমিত পতিদের কবিতায় বিশেষ বিশেষ কিছু শব্দ  প্রয়োগ, বা পংক্তি বিন্যাস  মনে দাগ কেটে যায়। আসলে এই প্রজন্মের তরুণ কবিরা যে কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন, প্রতীক, চিত্রকল্প ও ব্যঞ্জনার যে অসামান্য আড়াল-আবডালের  রহস্য সৃষ্টি করে চলেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কি শব্দ নির্মাণ এবং তার প্রয়োগ, কি বাক্য গঠনের প্রথাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা, কি প্রচলিত কাব্য কাঠামো ভেঙে চৌচির করে দিগন্তের পথে একাকী সাহসী যাত্রা,  সব কিছুতেই যেন কত শত মোহর   অবলীলায় জন্ম দিয়েছে  এরা। আসলে প্রবীন, মাঝারি ও নবীন কবিদের এক চিন্তাশীল সমন্বয়ে সংকলনটি যেন এক মহানদীর  জন্ম দিয়ে গেল।

 সবশেষে বলি, এত অল্প পরিসরে এই ধরনের নবীন-প্রবীণ "ক্লাস" কবিদের ধরা  কার্যত অসম্ভব । তাই অনেক নামই হয়তো উল্লেখ করা গেল না । তবে এটুকু বলতে পারি, অতি অল্প কিছু কবিতার  সামান্য কিছু দুর্বল  বিন্যাসের কথা বাদ দিলে, প্রতিটি কবিতার  নিবিড় পাঠে, যে গভীর অনুভব , সময় অতিক্রম করে কালজয়ী হয়ে  ওঠার যে অদম্য প্রবণতা তথা     contrast ও  variety বা multi colour  রচনার যে দুরন্ত সাহসিকতা ধরা পড়েছে, এককথায়,  তাতে অনন্যতার  ব্যঞ্জনারও  উত্তরণ ঘটেছে। প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় কবিদের নাম উল্লেখ ও  হালকা রং ব্যবহারের কৌশল  মুগ্ধ করে। তবে পিডিএফ ফাইল হিসেবে বইটি হাতে আসায় কাগজের গুনমান, রংয়ের  শৌখিনতা প্রভৃতি আরো অনেক কিছুই দেখা বাকি থেকে গেল।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614


1 comment:

  1. খুব সুন্দর হয়েছে আলোচনা

    ReplyDelete

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...