Saturday 10 October 2020

e-কোরাস ৩৯ // করোনা ও তাদের কথা

 


করোনা ও তাহাদের কথা

শ্রীতনু চৌধুরী

 তোমার করোনাবাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে সেখানে বাঁশ পুঁতে ঘিরে দিয়েছে পুলিশ। কুকুর আর পুলিশের কোনো প্রভেদ নেই। একজন মহামারীর প্রহরী আর অন্যজন আদিম ঊষাকাল থেকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের গৃহস্থালি। নিরাপদে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তথাকথিত মানুষ। ব্যারিকেড পেরিয়ে দাওয়ায় স্বস্থানে চলে গেছে প্রকৃত ভক্তি। পালিত বিড়াল ঘুলঘুলির ফাঁক গলে নিয়ে গেছে মাছের ভাগ, চিলেকোঠার পায়রা বসে আছে নিঝঝুম, নিয়মিত খবর নিয়ে গেছে শালিক-চড়াই। কেবল প্রতিবেশী বন্ধ করেছে জানলা কপাট। সরে সরে প্রাণভয়ে চলে গেছে অবশিষ্ট ছায়াও।

     তুমি জানাও নি কাকেও। শুধু কেশব কে বলেছিলে,তোমার অশীতিপর মা'কে ত্বরিত সরিয়ে নিয়ে যেতে। কেশব একবারও ভাবেনি নিজের নিরাপত্তার কথা। তোমার নিষেধ সত্ত্বেও তার থেকে জেনেছে শ্রীজিৎ। শ্রীজিৎ থেকে দেবাশীষ, বঙ্কিম,নিমাই।রিপোর্ট পেয়ে সরকারি ডাক্তার থেকেছে ভার্চুয়াল। ফোনের ওপার থেকে বাৎলেছেন ওষুধ পথ্য। সামান্য শ্বাসকষ্টে বলেছেন অক্সিজেন নাহলে এডমিট।তুমি রাজি হও নি। ভরসা রেখেছিলে নিজের উপর, নিজস্ব বৃত্তের উপর। হাসপাতাল থেকে তারপর আর কেউ যোগাযোগ করেনি। কিন্তু কি করে যেন পৌঁছে গেছে অক্সিজেন। সকালে দোরগোড়ায় নিয়মিত কেউ রেখে যেত সব্জি দুধ। কোন ঘুরপথে মাছ মাংসর ব্যাগ নিয়ে পৌঁছে যেত তারক পুলিশ তার টেরও পেত না। কুকুরটা ভুক ভুক করে তার চারপাশে কয়েকবার চক্কর কেটেছে কেবল। দোকানদার ছেলেটির হাত থেকে ওষুধের প্যাকেট নিয়ে প্রয়োজনের আগেই পৌঁছে যেত কেউ না কেউ। অন্তত ষোলো টা কান প্রস্তুত ছিল তোমার আদেশের জন্য।

    তারপর যখন করোনাকে পরাস্ত করে উঠে দাঁড়ালে, হট করে দরজা খুলে রাস্তায় পা রাখলে, দড়ি বাঁশ খুলে কোথায় চলে গেল। কুকুরটা সেদিনও পা'এ পা'এ ঘুরেছিল। সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিল দিনুর চা দোকান পর্যন্ত। সামান্য যারা জানতো, কিছু না বলে তারা  তফাতে গিয়ে বসল। যারা জানতো না তাদের ঐকান্তিক জিজ্ঞাসা-দাদা অনেকদিন পর যে? দিনু জানতো, তবুও দারুন উৎসাহে এগিয়ে দিল চা। সতর্ক হয়ে তুমি বললে,না রে এই মাত্র খেয়ে বেরিয়েছি। তারপর ওর দোকানের কথা ভেবে হাঁটা দিলে বাজারের দিকে। মুদিকে বললে, 'তারিনিকাকা খাতাটা দেখে রেখো,কাল আসবো'। অবাক তাকিয়ে তিনি বললেন,'খাতা কিসের রে! কিছু তো বাকি নেই'!আশ্চর্য হলে! সব্জিবালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সেও বললো-বাকি নেই! এমনি করে মাছওয়ালী বললো বাকি নেই,ফল দোকানি বললো বাকি নেই! মাংসর দোকান পেরিয়ে ওষুধ দোকানে গিয়ে দাঁড়ালে সেও বললো-না বাকি নেই! অথচ ওদেরকে তুমি পঁয় পঁয় করে বলেছিলে-'কোত্থাও পয়সা দিবি না,জানিস তো সব দোকানে আমার খাতা আছে'।

    বাড়ি ফিরতে ফিরতে তোমার আর একবার  নতজানু হতে ইচ্ছে করছিল ভালোবাসার কাছে মনুষ্যত্বর কাছে। পরদিন ওদের জিজ্ঞাসা করতে  সবাই এক বাক্যে বললো,'না আমরা তো কেউ কিছু করিনি তোমার জন্য'! নিরুপায় হয়ে কপট রাগ দেখিয়ে তুমি বললে-'এটা বেশ ভালো হল।এবার মিথ্যা মিথ্যী তোদেরকে ফোন করে বলবো-আমার আবার করোনা পজিটিভ! আর তারপর তোদের পয়সায় একমাস বসে বসে খাব! দেখি কতদিন খাওয়াস'!

 তুমি কাকেও জানাতে চাও নি। কারণ কিছু শুকনো সহানুভূতির চেয়ে প্ৰিয় মানুষগুলোর বিষণ্ণ মুখ তোমাকে ব্যথিত করে বেশি। এটাকে কি বলে সুকান্ত দা? প্রেম না মায়া!মাঝে মাঝে মানুষ যখন সন্ন্যাসী হয়ে যায়, আশপাশের কিছু হাত উজাড় ভালোবাসায় কুসুমাস্তীর্ণ করে দেয় তার আপাত কঠিন পথ। আর তুমি দেখলে-এখনো বন্ধু আছে,এখনো প্রকৃত মানুষ আছে ,অতিমারীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর জন্য ফুসফুসভর্তি বাতাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষবন্ধুর মতো কিছু স্বজন। তিতির মুনিরের মতো তারা কোথায় থাকে কেউ জানে না,কিন্তু অন্তিম পথের সারমেয়র মত তারা আছে। তারাই প্রকৃত ধর্ম-পৃথিবীর শেষতম প্রেম।


উৎসর্গ : কবি সুকান্ত সিংহ


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - কোরাস
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614





No comments:

Post a Comment

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...