আমি এক নদী
অমৃত মাইতি
আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার দিকে। আমার সিদ্ধান্ত নির্ভুল। বাধা পেয়ে আমি বিচলিত হই না। অনতিক্রম্য হলে আমি আমার পথ ঘুরিয়ে নিই লক্ষ্যবস্তু কিন্তু ঠিক থাকে। চলার পথে আমার কৌশল বদলাতে হয়। কিন্তু মোহনায় যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত আমি বদলাই না। বাধা পেলে আটকে যাই না। কৌশল বদলাই ঠিকই কিন্তু কৌশলটা আমার শেষ কথা নয়। আমার শেষ কথা মোহনায় যাওয়া। আঁকাবাঁকা পথে মনে হয় আমি বোধহয় কোথাও হারিয়ে গেছি। কিন্তু না। আমার সঙ্গে এগোতে থাকো দেখবে আবার বাঁক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে। চপলমতি মানুষ আমাকে ভুল বুঝতে পারে। বাঁক নেওয়ার সময় মনে হতে পারে আমি হারিয়ে গেছি। পরক্ষণে তুমি দেখবে তোমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার জন্য জন্মাইনি। নদীর স্থবিরতা তার কলঙ্কময় জীবন। গতিময় নদী তার বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখে। সে কিছুতেই শ্যাওলা জমতে দেয় না তার দেহে। শ্যাওলা জমে যাওয়া তার সৃষ্টির অসম্মান। শ্যাওলা শরীরকে অসুস্থ করে দেয়। তার গতিপথ সমাজদেহ ভূমিপৃষ্ঠ তার বক্ষস্থল । তার অবলম্বন। বালি মাটি কাঁকর পাথর ভাঙ্গা নুড়ি নদীর অলংকার। নদীর দুই পাড়ে সবুজ বনানী জনপদ জনতার আদালত তার পাহারাদার। আমি এমনি এক নদী কখনো আমার ভাঙ্গনের রুপ দেখে মানুষ মনে করে এই বুঝি নদী হারিয়ে গেল অন্য পথে। সজাগ জনপদ সজাগ জনতা ঠিক আমার পাশে সতর্ক প্রহরার মতো আমাকে সঠিক রাস্তায় প্রবাহিত করার শত চেষ্টা তাদের। কত অন্ধকার রাত্রি নক্ষত্র তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। বেগবতী নদী সব দেখে। নদীর নির্ঘুম রাত কাটে অমাবস্যার সৌন্দর্য আর তার শরীরের ঢেউ গুনতে গুনতে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস আর ভাটিয়ালি সুরে মাঝির গান নদীকে পাগল করে দেয়। নদী যেন নান্দনিক তত্ত্বের জন্মদাত্রী। বুড়িগঙ্গা থেকে বরিশালের পথে লঞ্চের ডেকে বসে বসে রাতের গঙ্গার মোহিনী রূপ আর দুই তীরের অপরূপ রূপে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। নিজেরই অজান্তে কখনো নদী হয়ে যাই । মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা সত্যিই যদি নদী হয়ে যায় তাহলে এক আদর্শ জীবনের খোঁজ পাই।নদীকে অস্বীকার করে না কেউ ,যদিও সে হারিয়ে যায় মোহনায় । কিন্তু উৎসকে অস্বীকার করা মুর্খামি এবং স্থূল-বুদ্ধির পরিচয়ক। মোহনাও জানে তার সমস্ত নির্জনতা নদীর সঙ্গমস্থল। আমি এখন মোহনায় যাব সেখানে কি সীমাহীন নির্জনতা। মোহনা আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। মোহনা আমাকে ডাকছে তার সীমাহীন সৌন্দর্য আর নির্জনতায় ভরিয়ে দিবে আমাকে। জীবনানন্দ তখন আমাকে কানে কানে বলে,"তুমি জল, তুমি ঢেউ -সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন /তোমার দেহের বেগ তোমার সহজ মন/ভেসে যায় সাগরের জলে আবেগে"।
সেদিন রাতের অন্ধকারে জল আর ঢেউ ভালবেসে লঞ্চে উঠেছিলাম।"তোমাকে কে ভালবাসে,তোমারে কি কেউ/বুকে ধরে রাখে/জলের আবেগে তুমি চলে যাও/জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধুধু জল তোমারে যে ডাকে/। আমি তখন তাকিয়ে বরিশালের দিকে। হয়তো বরিশালও আমার দিকে তাকিয়ে আছে আপ্যায়নের জন্য।যেন " নিশীথের বাতাসের মতো/একদিন এসেছিলে,/দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারি যত"/কেবিনে গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করি।"ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে"।"ওইদিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর"। আদিম রাত্রির ঘ্রাণ/বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান"। ইচ্ছে তো জাগেই নদী হয়ে যেতে।"ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে ধীরে পৌষের রাতে-কোনদিন জাগবো না আর/কোনদিন জাগবো না আমি কোনদিন আর"।
আমিও মনে করি আমি নদীর মত। আমিও নদী ভালবেসে তার জল আর ঢেউ ভালোবেসে নিজের শরীরটাকে ভেঙ্গে চুরে তার সমস্ত গুণাবলী গায়ে মেখে নিয়ে নদী হয়ে যাই।
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪