শিরোনাম ঘাটাল : পাপিয়া ভট্টাচার্য
কত বছর ধরে ঠিক জানি না,তবে আমাদের জন্মের আগে থেকেই বাবা জানত মাস্টার প্ল্যান হবে।জ্ঞান হওয়া অবধি আমিও প্রতি বড় বন্যায় শুনে এসেছি মাস্টার প্ল্যানের দ্রুত রূপায়ণের গল্প,আমার ছেলেও শুনে যাচ্ছে। তারপর তো অবস্থা এই!
পড়ে গিয়ে আমার হাঁটু কনুইতে চোট ,তিনদিনের অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, হঠাৎ বাবা মার বাড়িতে এসে আটকে পড়েছিলাম। মা বাবা হীন শূন্য বাড়িতে থাকতে কষ্ট হয়, কিন্ত প্রবল বৃষ্টির মধ্যে এবাড়ির কেয়ারটেকার মেয়েটির যত্নে সংসারিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্রাম পাচ্ছিলাম বলে ভালো লাগছিল।
একটানা অঝোরে টানা বৃষ্টির পর বন্যা আসছে, বলতে না বলতেই রাতারাতি প্রবল জলস্রোতে ভেসে গেল সব। সে এমনই অবস্থা ,বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় রইল না,ফেরার কথা তো ভাবাই যায় না।
আমাদের বাড়ির অবস্থান এ তল্লাটে সবচেয়ে সুবিধেজনক উঁচু স্থানে । মাস্টারমশায়ের বাড়িও এবার ডুবছে ,এটা এখনও জলের ভয়াবহতা বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করছে পাশাপাশি মানুষেরা, এবারেও দেখলাম। ফলে এবাড়িতে যখন সারারাত ধরে জল ঢুকতে শুরু করল, বুঝলাম কী ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে চলেছে ! কয়েক ঘন্টার মধ্যে পুকুর চাতাল বাগান সব একে একে ডুবে বাড়িতে জল থই থই। উঠোন ভর্তি জল থেকে উঠে আসছে সাপ ব্যাং , অজস্র বিশাল বিশাল কেঁচো, বড় বড় কাঁকড়া শামুক , রাজ্যের পোকা মাকড়। কারেন্ট নেই,নেট নেই, টিভি নেই, নেটওয়ার্ক অবধি নেই যে ফোনে কাউকে যোগাযোগ করব ! তখন আর জি কর কান্ড নিয়ে উদ্বেগ বহুদূর, বাড়ির কৌলিক পুজোটি কিভাবে নির্বিঘ্নে হবে তাও ভুলে গেছি, সোমবার রাত্রি থেকে শুক্রবারের দুপুর সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চারদিক জলে ঘেরা নির্জন দ্বীপে বাস! জলের কলকল শব্দ আর সাপের উঁকি ঝুকি ছাড়া আর কিছু নেই। সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা ! আর হ্যাঁ, ছাদে ছানাপোনা নিয়ে কটা হনুমান আশ্রয় নিয়েছিল বটে ! আমাদের বাগানের যত পেয়ারা, এখন অন্য ফল আর কিছু নেই, শেষ করে করুণ মুখে তাকিয়ে থাকত খিদের জ্বালায়। বাড়িতে থাকার মধ্যে কিছু আলু পেঁয়াজ ডিম। তাও ওই ভরা স্রোতের মধ্যে অনেক ঝুকি নিয়ে সাঁতার কেটে বাবা মার স্নেহের সাহায্যকারী ছেলেগুলি দিয়ে গেছল বলে। তারই কিছু আলু ও বেচারিদের সঙ্গে ভাগ করেই খেতে হচ্ছিল দুদিন।
এখন তাও ইনভার্টার এর আলো আছে,এইটুকু ভরসা।
শীলাবতীর ওপারে এই বিভীষিকা এত তীব্র নয়, এপার প্রতিবছরই কম বেশি মার খেয়ে চলেছে। সারারাত জলের কলকল শব্দ শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল তখনকার অন্ধকার সময়। একতলা ডুবে যাওয়া ,বন্যায় ঘর পড়ে যাওয়া আশ্রিত মানুষগুলির জন্যে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হ্যারিকেনের সামান্য আলোয় বেঞ্চের ওপর তোলা উনুনে মা সবার জন্য খিচুড়ি রান্না করছে,শুকনো কাপড় চোপড়ের ব্যবস্থায় বাবা । তখন বাবার পুকুরভর্তি মাছ ,লকলকে সতেজ মাঠের পর মাঠ ভর্তি ধান, যা সেসময়ের সাধারণ একজন শিক্ষকের আয়ের প্রধান উৎস ,গ্রামের সবারই প্রধান আয়ের পথ,সব ভেসে গিয়ে মানসিক চাপে দিশেহারা বাবা। আমরা ভাইবোন ,আশ্রয় নেওয়া লোকজন কুঁকড়ে বসে আছি। মাঝে মাঝে দূরে কাছে শাঁখ বাজছে, ঝুপ করে কোন বাড়ির একতলা ভেঙ্গে পড়ল। এখনো যদি কোথাও একটা বাঁধ না ভাঙে, নিশ্চিত মৃত্যু। শেষ অবধি অবশ্য একটা বাঁধ ভাঙ্গতই অতিরিক্ত জলের চাপ সহ্য করতে না পেরে, ওপারের মানুষ বিপদে পড়বে জেনেও সেই ভাঙ্গন আশীর্বাদ হয়ে আসত আমাদের কাছে।
বহুবছর আর এখানে থাকি না এসময়। কিন্তু থাকি আর না থাকি ,মায়ের আকস্মিক চলে যাওয়ার আগে অবধি এরকম হঠাৎ করে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া বন্যা আসার খবরে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। এ ভয়ংকর জলস্রোত এমনভাবেই আসে,মুহূর্তমাত্র সময় দেয় না। সোমবারের রাত্রি থেকে শুক্রবার পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন জনমানবহীন অবস্থায় ঘরে বাইরে শুধু জলের শব্দ শুনতে শুনতে আত্ংকের মধ্যেও ভেবেছি 2015 র সেই হঠাৎ আসা বন্যার কথা। বাবা তখন ডিমেনশিয়ার শেষ পর্যায়ে,আর কমাস পরেই চলে যাবে আমাদের ছেড়ে। হঠাৎ রাতারাতি সব ডুবে বাড়িতে জল। মাস্টারমশায়ের বাড়িতে জল ওঠা মানেই গোটা গ্রাম ডুবেছে, জানা কথাই। বাবার দুটি সাহায্যকারী ছেলে আর বাড়ির কাজে মায়ের সাহায্যকারী মেয়েটির বাড়িও। কেউ আসতে পারে নি তিনদিন। আমার শান্ত নিরুপায় মা প্রায় অচেতন মানুষটিকে নিয়ে দোতলাতেও উঠতে পারেনি। কিভাবে একা রুগী বাড়ি সব সামলেছিল মা ,ভেবে ভেতরটা কাঁপে এখনও! আমি কাছেই ঘাটালে ছিলাম,কিন্তু শীলাবতীর ওপারে । যেখানে শীলাবতী নদীর বাঁধ না ভাঙ্গা অবধি লোকজন ফুঁসে ওঠা ও উপচে পড়া নদীর দুইপাড়ের সংযোগ রক্ষাকারী একমাত্র হেরিটেজ ভাসা ব্রিজের নৌকোগুলি খুলে ভাসিয়ে দেওয়া, বাঁধন মুক্ত হয়ে প্রবল স্রোতে সেগুলির দ্রুত মোহনার দিকে ছুটে যাওয়া, নদীপাড়ের ওপারের বাঁধে বস্তার পর বালির বস্তা চাপিয়ে শীলাবতীর ওপারে ঢুকে পড়া থেকে কোনোভাবে আটকানোর চেষ্টা ,এপারের ডুবন্ত ঘরবাড়ি বাজার দোকান....এসব দলে দলে দেখতে বেরোয় নিরাপদ দূরত্ব থেকে। ওপার আর এপারের চিরকালের এই পার্থক্য!
অবশ্য কয়েক বছর ছাড়াই এখন ওপারও ডোবে। তখন মিডিয়ার দৌড়াদৌড়ি, বিশাল লেখালেখি ,টিভির খবর ,হেলিকপ্টারের আনাগোনা। কারণ এপারে ব্যবসা বাণিজ্য দোকান বাজার ,গ্রামের পর গ্রাম ,তুলনায় ওপারের শহরটি অনেক সমৃদ্ধ। এস ডিওর বাংলো থেকে সমস্ত ব্যাংক, অফিস ,ট্রেজারি সবই ওপারে। ওরা আলো বেশি পাবেই।
সব পচে ওঠা এপারে তখন জল কমে যাওয়ার সাময়িক স্বস্তি। নিজেদের দুর্দশা ভুলে মহা উৎসাহে এপারের লোক তখন নদীর ওপারে ভিড় করছে বন্যার দহে হেলে পড়া বিশাল বাড়ির ছাদ থেকে হেলিকপটারের উদ্ধার করার দৃশ্য দেখার জন্যে। কত দশক ধরে এইভাবে চলছে 🥲🥲। সম্ভবত চলতেই থাকবে।
বি: দ্র:- প্রতিবছরের এই প্রলয়ংকরী বন্যা থেকে ঝড়, আমফান আয়লা ফণি ইত্যাদি সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানেই সরকারী বেসরকারী কেন্দ্র রাজ্য থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে অর্থ ,প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, নতুন গৃহ নির্মাণের টাকা ইত্যাদি নানা ভাবে প্রচুর ত্রাণ আসবে, যার ছিটেফোঁটা পৌঁছবে প্রকৃত প্রাপকদের কাছে ! যেমন ত্রাণের দু আড়াইশো ত্রিপল এলে দলের বাইরে জনা পনেরো কুড়ি ,এই হিসেবে অন্য বিশাল অনুদান গুলির জিনিসপত্রের ভাগ সহজেই অনুমেয়। বাকি সব উন্নয়ন !রাস্তার মোড়ে মোড়ে যা দাঁড়িয়ে আছে!( হায় ! শিকড় হইতে কান্ড ,শাখা প্রশাখা হইতে পত্র পুষ্প শিরা উপশিরাগুলিতেও পচন ধরিয়া গিয়াছে !)
শুধু রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম এরকম কিছু প্রতিষ্ঠান , ব্যক্তিগত স্তরেও কিছু জন, সব তো জানি না আমি ,ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, তাঁদের কাছে দলাদলি পক্ষাপক্ষ নেই,সবাই সমান। এই পোস্ট পড়ে আমার অনেক চেনা মানুষ, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসবে সমর্থন করে ও জড়িত, তারাও আমার ওপর ক্ষুব্ধ এবং বিরূপ হবে জানি। কিন্তু এভাবে প্রিয় থাকার ইচ্ছে আমার কোনোদিনই কারো কাছেই ছিল না, নেইও। তাই আমার অতি ক্ষুদ্র সাধ্যমত যেকোনো দুর্নীতির প্রতিবাদ করে গেছি প্রথম থেকেই। আজও যদি না বলি, তাহলে আমার আদ্যন্ত সৎ ও লড়াকু কংগ্রেসী বাবার মেয়ে হয়ে আমি নিজের কাছেই একদম ছোট হয়ে যাব। লিখতে গিয়ে তাই বাবা ছাড়া আর কারোর মুখই ভাবছি না। কড়াইয়ের মত এই অঞ্চলে বন্যা চিরদিনই ছিল ,অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো
থাকবেই। স্বল্প না বেশি পরিমাণ জানি না ,তবে কেন্দ্র রাজ্য থেকে ত্রাণ তখনও আসত । বাবা দাদুরা তখন পঞ্চায়েতের মাথা ছিল।( তখন পঞ্চায়েতের প্রধানরা শিক্ষক গোত্রের হত, মোটামুটি শিক্ষিত লোকজন থাকত। এখন তো শুনি নিরক্ষর, অর্ধ নিরক্ষর দের প্রধান নামক সম্মানিত পদটি দেওয়া হয় , তাঁদের কাজ শুধু যেখানে বলবে সেখানে চোখ বন্ধ করে সই করে দেওয়া।) যাই হোক ,সেই ত্রাণের শেষ জিনিসটি পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত দাবিদার মানুষের কাছে পৌঁছে না দেওয়া অবধি সমস্ত ত্রাণসামগ্রী নিরাপদ পাহারায় রাখার কারণে বাবারা উৎকণ্ঠিত থাকত। এবং উদ্বৃত্ত কিছু আর নিজেদের সম্বল দিয়ে ভেঙ্গে পড়া বাড়ির দুর্গত মানুষের জন্য লঙ্গরখানাও খুলত কিছুদিনের জন্য। প্রসঙ্গত, আমরা বন্ধুরা সেখানেই প্রথম ট্যারা বাঁকা করে রুটি বেলতে শিখেছিলাম, বাবাদের স্বেচ্ছাশ্রম শেখানোর প্রয়াসে। সেসময়ের মানুষদের মনে বোধহয় দেশোদ্ধার,সমাজের উপকার ইত্যাদি ইত্যাদি কিছু মূল্যবোধে বিশ্বাস ছিল তখনও ,মানে নির্বোধ ছিল আর কি ! ফলে স্বীয় স্বীয় উন্নয়নে মনোনিবেশ করে নাই।
এবার আসন্ন মাস্টার প্ল্যানের কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে মাত্র গোটা কয় কথা বাকি। শুরু এবার হতে পারে !হতেই পারে! তবে সেই বিশাল অংকের অর্থের কতখানি জনগণহিতায় লাগবে আর কতটাই বা অন্য সব মহৎ কাজে , সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন ( এখন লাখ লাখের মত তুচ্ছ সংখ্যা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না,সবই এসে কোটিতে ঠেকেছে)!
পুনশ্চ: - এবারের বন্যা এতোই ভয়ংকর হয়েছিল যে কোথাও একটা বাঁধ ভাঙ্গার মধুর খবরের ( এপারের মানুষের কাছে ) অপেক্ষায় শুকনো মুখে সকলে আকুল হয়ে প্রহর গুণছিল। একে একে বামনখানা,কাঁসাই, শীলাবতীর বাঁধ ভাঙ্গছে আর আমরা বিন্দুমাত্র তাদের দুর্গতির কথা না ভেবে নিজেদের উদ্ধারের কথা ভাবছি ! এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু ! এরকম দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আমাদের হাতে আর বিকল্প কী-ই বা থাকতে পারে !
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
ছবি - পাপিয়া ভট্টাচার্য
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment