Monday 15 April 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১৮

 




পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১৮

আনন্দময়ী– খড়ার, ঘাটাল

শ্রীজিৎ জানা


শতাব্দী প্রাচীন পৌরসভা খড়ার। খড়ার পৌরসভা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৮৮৮ সালে। ১৮৮৪ সালে তৎকালীন বেঙ্গল মিউনিসিপালিটি অ্যাক্টের ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী খড়ার পৌরসভা তার আয়ত্তাধীন রায়েরডাঙা,কৃষ্ণপুর,উদয়গঞ্জ এবং দলপতিপুর গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে খড়ার ছিল হুগলি জেলার অধীন। ১৮৭২ সালে খড়ার মেদিনীপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাচীন খড়ারের পরিচিতি তার ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পের জন্য। সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে দেশ। বিজলীবাতির আলো তখনো সেভাবে পৌঁছায়নি খড়ার পৌর এলাকার সর্বত্র। ঠিক সেই সময়ে বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠল তিন নম্বর ওয়ার্ডের সিনেমাতলা। চারিদিকে যখন টিমটিম করে জ্বলছে কেরোসিনের আলো। ঠিক সেই সময় হাস্কিং মেশিনের ( জেনারেটর )  আলোয় ঝলমল করছে 'আনন্দময়ী' সিনেমাহল চত্বর। দুপুর থেকে রাত অব্দি গমগম করত সিনেমাতলা। 

প্রয়াত হরগোবিন্দ মুখার্জী ছিলেন পেশায় হাতুড়ে ডাক্তার। মুখার্জী পরিবার এলাকায় বেশ প্রভাবশালী ছিলেন।  শ্রী মুখার্জী ছিলেন রাশভারী মানুষ। ডানপন্থী রাজনীতি করতেন। এমনকি খড়ার পৌরসভার চেয়ারম্যানও হন। হঠাৎ ডাক্তারি ছেড়ে করলেন সিনেমাহল।

আনুমানিক পঞ্চাশের দশকের গোড়াতে তাঁর হাত ধরেই আনন্দময়ীর যাত্রা শুরু হয়। আনন্দময়ীর নামকরণ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেন মুখার্জী পরিবারের কুলদেবী মা তারা আনন্দময়ীর নামে সিনেমাহলের নাম রাখা হয়। আবার অনেকে দাবী করেন হরগোবিন্দ বাবুর বড় মেয়ে আনন্দময়ীর নামে সিনেমাহলের নামকরণ করেন। নামে কী আসে যায় বলুন তো! আনন্দময়ী কয়েক দশক ধরে খড়ার সহ পার্শ্ববর্তী বিনোদন প্রিয় বাঙালিকে যে মাতিয়ে রেখেছিল,সেটাই আসল কথা।  প্রায় ছ'শ আসন বিশিষ্ট আনন্দময়ী প্রেক্ষাগৃহ। শুরুর দিকে ফ্রন্ট স্টলে থাকত কাঠের বেঞ্চ। টিকিট মূল্য ছিল ১৯ পয়সা। মিডিল স্টলে ছিল হাতলওয়ালা চেয়ার। টিকিট মূল্য ৪০ পয়সা। আর রেয়ার স্টলে ছিল হাতলওয়ালা স্টীলের চেয়ার। টিকিট মূল্য ছিল ৭৫ পয়সা। আনন্দময়ীর ব্যালকনি যেমন ছিল, সাথে দু'পাশে ছিল বক্স। সেখানে টিকিট মূল্য সেইসময় ছিল এক টাকা। শো টাইম ছিল দুটি, তিনটা এবং ছ'টা। খড়ার পৌরসভার বাসিন্দা শ্রী সুকুমার ঘোষ বলেন," আমাদের আনন্দ উপভোগের প্রাণকেন্দ্র ছিল ওই সিনেমাতলা। কৈশোর, যৌবনের অনেক সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই আনন্দময়ীর সঙ্গে। তখন উপচে পড়ত দর্শক। টিকিট ব্ল্যাক হত। সামাজিক এবং ধর্মীয় ছবিগুলোতে ভীড় হত চোখে পড়ার মত।  সঙ্গম, টারজান, কিংকং প্রভৃতি ছবি মারত্মক চলে। ফুলেশ্বরী, সঙ্গম, প্রথম কদম ফুল সিনেমা বহুদিন ব্যাপী চলেছিল এই সিনেমাহলে"। আনন্দময়ীর ছবির প্রচারেও ছিল চমক। খড়ার নিবাসী কালিপদা হাজরা পিঠে প্লাকার্ড ঝুলিয়ে,হাতে টিনের চোঙা নিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রচার করতেন। যাত্রার অভিনয়ের মতো করে বলতেন কথা। পথচলতি মানুষজন দাঁড়িয়েে শুনতেন তার হাঁকানোর কৌশল। স্টাফ ছিলেন ১০- ১২ জন। চারজন গেট কিপার। তিনজন টিকিট কাউন্টরে থাকতেন। ম্যানেজার ছিলেন খড়ারের অসিবত ঘোষ। চিফ অপারেটর ছিলেন খড়ারের বনমালী কর্মকার।  পরে হন তাঁর পুত্র বিশ্বজিৎ কর্মকার। সহযোগী অপারেটর ছিলেন পীযূষ ঘোষ। 

  সালটা ১৯৭১।  নকশালদের হাতে খুন হলেন হরগোবিন্দ মুখার্জী। সিনেমার লাস্ট শো শেষে, ওই সিনেমাহলের সামনেই তাকে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়। মর্মান্তিক সেই ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর সিনেমাহলের দায়িত্ব নেন প্রণবকুমার মুখার্জী। তিনি বেশ কিছুদিন চালচনোর পর সিনেমাহল লিজে দিয়ে দেন। খড়ারের পাশেই মামুদপুর ( চন্দ্রকোনা -২) গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন প্রদ্যোৎ পাঁজা। যিনি প্রথম থেকেই কলকাতার সিনেমা জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। একদিকে যেমন তিনি ছবির ব্রোকার ছিলেন, সাথে প্রযোজনার কাজও করতেন। সন্ধ্যা রায় অভিনীত 'টগরী' সিনেমা তিনিই প্রযোজনা করেন। আনন্দময়ী তাঁর হাত ধরে আবার সগৌরবে চলতে থাকে। কিন্তু দু'হাজার সালের পর থেকেই লিজ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মুখার্জী এবং পাঁজাদের মধ্যে বিবাদ তৈরি হয়। মামলা গড়ায় কোর্টে। রায় বের হয় মুখার্জীদের পক্ষে। আনন্দময়ী বন্ধ হয়ে যায়। আনুমানিক ২০০২-  ২০০৩ সাল নাগাদ সিনেমাহল বন্ধ হয়

আনন্দময়ী সিনেমাহলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেক সোনালী স্মৃতি। সিনেমার শো টাইমের আগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়ায় দেওয়া হত। ১৯৯০ সালে এমনি একটি সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন সুরতীর্থ সঙ্গীত বিদ্যালয়। যার প্রতিষ্ঠাতা গৌরীপ্রসাদ বিশ্বাস। এই সঙ্গীত কেন্দ্রের আয়োজন ও আমন্ত্রণে আসেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়।সেদিনও সঙ্গীতপ্রেমীদের ভীড়ে উপচে পড়ে প্রেক্ষাগৃহ। তবে আনন্দময়ীর ইতিহাসে সবচেয়ে হর্ষ - বিষাদের বছর হল ১৯৭১। ওই বছর প্রয়াত হন প্রতিষ্ঠাতা হরগোবিন্দ বাবু। কিন্তু তাঁর মৃত্যর আগে ওই প্রেক্ষাগৃহে নেচে মাতিয়ে দেন চুমকি এবং রুমকি রায়। আচেনা ঠেকছে নিশ্চয়ই নাম দুটো। চুমকি রায় হলেন দেবশ্রী রায়। যদিও তখনো তিনি দেবশ্রী রায় হন নি।আর তাঁর ছোট বোন তনুশ্রী রায় ওরফে রুমকি রায়। দেবশ্রী রায়ের বয়স তখন এবার বার বছর। আর ওই বছরই হিন্দি 'হরে কৃষ্ণ হরে রাম' ফিল্ম রিলিজ হয়েছে।  যেই ছবির বিখ্যাত গান 'দম মারো দম. মিট জায়ে গম…'। ওই গানে দুই বোনের মন মাতানো নাচ আজও ভুলতে পারেন নি সেদিনের অনেক দর্শক। ওই টিমে ছিলেন চিন্ময় চ্যাটার্জি।  পাঁচ টাকা ছিলে সেদিনের ওই অনুষ্ঠানের টিকিট মূল্য। শো হাউসফুল। সেই দিনের কথা আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে অনেকের মনে। আর বড্ড অনাদরে আজ দাঁোড়িয়ে আছে সেদিনের গমগম করা বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র আনন্দময়ী প্রেক্ষাগৃহ। 


তথ্যসূত্রঃ –

১. শ্রী গৌতম মুখার্জী - খড়ার

২. শ্রী সুকুমার ঘোষ –খড়ার

৩.শ্রী বিমল ঘোষ – খড়ার


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

ইতি মণ্ডল এর কবিতা // ই-কোরাস ১৭৮

  ইতি মণ্ডল এর কবিতা   ১. পতিতা আমার জঠর থেকে নিষিক্ত ডিম্বানু দিয়ে, সৃষ্টি করো তোমাদের কাল জয়ী  নারীশক্তি…                      দেবী দুর্...