Thursday 29 February 2024

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ১৫

 



পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ১৫

জ্যোতিশ্রী টকিজ এবং পূজা টকিজ– চন্দ্রকোণা 

শ্রীজিৎ জানা


বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলির ঐতিহাসিক চন্দ্রকোণা। আজও শহরটা ঘুরলে ছবির মতো চোখে ভেসে উঠবে অতীত। জীর্ণ দেওয়ালের ভিতর থেকে অস্ফূট স্বরে শোনা যাবে রাজা রাজড়াদের গল্পগাথা। এমন শহরে বিনোদন কেন্দ্র থাকবে না, তা কখনো হয়! 'জ্যোতিশ্রী টকিজ' এর জন্ম এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে। সারটা ১৯৪৭। তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুরে প্রথম সিনেমাহলের লাইসেন্স পায় মেদিনীপুর শহরের 'আরোরা সিনেমা', দ্বিতীয় তমলুকের চলন্তিকা এবং তৃতীয় জ্যোতিশ্রী। প্রতিষ্ঠাতা হলেন জ্যোতিন্দ্র নাথ গোস্বামী। চন্দ্রকোণার বৈকুন্ঠপুর গ্রামের অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন গোস্বামী পরিবার। ছোটখাটো জমিদার বললেও ভুল হবে না। তবে শুরুর দিকে জ্যোতিন্দ্রনাথ অনেক কষ্ট করেছিলেন। কলকাতার যাজন বৃত্তি করতেন গোস্বামীরা। সেইসূত্রে জ্যোতিন্দ্রনাথ ছিলেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী কানন দেবীর কুলপুরোহিত। সেই সুবাদে টালিগঞ্জের অনেক অভিনেরতা অভিনেরত্রীদের সঙ্গে তাঁদের ভালোমত যোগাযোগ হয়। এদিকে জ্যোতিন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে নিজস্ব অর্থ প্রতিপত্তি গড়ে তুলেন। একসময় কলকাতার বুকে তের খানা বাড়ির মালিক ছিলেন জ্যোতিন্দ্রনাথ। তাঁর পুত্র বিষ্ণুসাধন গোস্বামীর বন্ধু ছিলেন কলকাতার 'পূর্ণশ্রী টকিজ' এর মালিক। তিনি আসামে মিলিটারি ক্যাম্পে সিনেমা দেখাতে যেতেন।সেই দেখে বিষ্ণুসাধন গোস্বামী সহ পরিবারের সিনেমার প্রতি ঝোঁক বাড়ে। চন্দ্রকোণার গোঁসাইবাজার সংলগ্ন স্থানে গড়ে ওঠে জ্যোতিশ্রী টকিজ। টিনের ঝাউনি আর মাটির দেয়াল দেওয়া ঘর।পাটাতনের উপর দর্শকদের বসতে হত। টিকিট মূল্য ছিল দশ ওবং কুড়ি পয়সা। তিনমাসের বেশি লাইসেন্স মিলত না।  ফলে ওই তিনমাস করে হল চলেই বন্ধ থাকত। জ্যোতিশ্রীর সূচনা পর্বের স্মৃতিচারণ করনতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় রূপকুমার গোস্বামী বলেন, " আমি তখন ছোট কিন্তু সেদিনগুলোর ছবি যেন চোখের সামনে ভাসে। তখন চন্দ্রকোণা এলাকায় সিনেমা দেখানো হবে, জেনারেটরের আলো জ্বলবে - এটাই এলাকাবাসী সহ দূরদূরান্তের মানুষের কাছে ছিল বিস্ময়। পায়ে হেঁটে,গরুর গাড়ি করে সিনেমা দেখতে আসত লোকজন'। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৬০ অব্দি অনিয়মিতভাবে চলেছে জ্যোতিশ্রী। আগে নির্বাক চলচিত্রও দেখানোে হয়েছে। তখন ওই সন্ধেবেলা একটা করেই শো চলত। ১৯৬১ সালে পুরানো জ্যোতিশ্রীর কাঠামো ভেঙে ফেলে নতুন রূপ দেওয়া হয়।গোস্বামী পরিবারের পিয়ারীমোহন গোস্বামী,বিষ্ণুসাধন গোস্বামী,রাধামোহন গোস্বামী এবং হরিসাধন গোস্বামীদের সম্মিলিত নবরূপে শুভ মহরৎ হয় জ্যোতিশ্রী টকিজের। কংক্রিটের দেয়াল আর টিনের ছাউনি পড়ে। কাঠের চেয়ার বসানোে হয়। সিট সংখ্যা ছিল পাঁচশ। তবে এই নতুন সিনেমাহলে ছবি চলাকালীন মাঝেমধ্যেই ফ্লিম কেটে যেত। সেক্ষেত্রে অনেকবার ভাঙচুরেরও ঘটনা ঘটেছে। জ্যোতিশ্রী বরবরই অনিয়মিত ভাবে চলেছে।

এরই মাঝে গোস্বামী পরিবারের অন্যতম রূপকুমার গোস্বামী বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স পাশ করে কলকাতা থেকে চলে আসেন। এদিকে তখন সিনেরমাহলকে ব্লাক লিস্ট করে দেওয়া হয়েছে। অনেক ছোটাছুটি করে রূপকুমার বাবু প্রেক্ষাগৃহের পুনরায় লাইসেন্স নবীকরন করেন। এদিকে পরিবারের অন্যরা সিনেরমাহল চালুর ব্যাপারে হাত তুলে নিয়েছেন। তখন কাকা রাধারমণ গোস্বামীর কাছ থেকে আড়াইশ টাকা এবং মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সাড়ে সাতশ টাকা,মোট হাজার টাকা সম্বল করে নেমে পড়লেন সিনেমাহল ব্যবসায়। টালিগঞ্জের চন্ডীমাতা পিকচার্সের ভবেশ কুন্ডু ছিলন আগে থেকেই পরিচিবত। প্রতি মাঘী পূর্ণিমায় আসতেন চন্দ্রকোণার বৈকুন্ঠপুরের বাড়িতে। তাঁর সহযোগিতায় রূপকুমার বাবু দু'শ টাকা মূল্যে এক সপ্তাহের জন্য আনলেন সিনেমা 'কুহক'। দ্বিতীয় ছবি আনলেন হিন্দি 'আলবেলা'। সেভাবে দর্শক টানতে পারল না দুটো ছবিই। এদিকে তিনি কপর্দকশূণ।  এমনসময়ে কলকাতায় যখন হন্যে হয়ে ঘুরছেন, ঠিক তখন দেখা হয় পূর্বপরিচিত প্রীতি মজুমদার নামের এক ব্যাক্তির সঙ্গে। যিনি ছিলেন কলকাতার পিয়ালী পিকচার্সের ম্যানেজার। তিনি সব শুনে সাহায্যের হাত বকড়ালেন। বিনা অর্থে দিলেন পরপর তিনটি ছবি – কায়াহীনের কাহিনী, বসন্ত বিলাপ এবং মর্জিনা আব্দাল্লা। সেই ছিল জ্যোতিশ্রীর টার্নিং মোমেন্ট। তখন টিকিট মূল্য ছিল ২৫ পয়সা,৫০ পয়সা এবং ৭৫ পয়সা। প্রতিদিন পাঁচশ টাকার টিকিট বিক্রি হতে লাগল। দু'বছর রূপকুমার গোস্বামীর হাতে লাভের শীর্ষে পৌঁছে গেল জ্যোতিশ্রী। ঠিক এই সময়ে সিনেমাহলের অংশীদারিত্ব নিয়ে শুরু হল বিবাদ। সিনেমাহলে তালা পড়ল। রূপকুমার গোস্বামী চালু করলেন মোমবাতি তৈরির কারখানা। সেখানেও অনেক কষ্ট সইতে হয় তাঁকে। তবে ধীরে ধীরে ব্যবসাকে বড় করেন। একে একে আরও অন্যান্য ব্যবসা ফাঁদলেন। কিন্তু রক্তে তাঁর সিনেমাহল ব্যবসার নেশা। থামলেন না কিছুতেই।


এবার রূপকুমার গোেস্বামী নিজস্ব পুঁজিতে,নিজস্ব মালিকানায় জন্ম দিলেন নতুন সিনেমাহল 'পূজা টকিজ'। জিগ্যেস করলুম কেন নাম রাখলেন পূজা? বললেন, "গোস্বামী পরিবারের আমরা,গোপীনাথ আমাদের আরাধ্য এবং পূজাঅর্চনাই আমাদের প্রধান কর্ম ছিল, সেই কারণে নাম রাখলাম পূজা"। ১৯৯৬ সালের ২৬ শে জানুয়ারী পূজা টকিজের শুভযাত্রা শুরু হয়। পূজার সিট সংখ্যা ছিল ব্যালকনির ১৬০ টি সিট সহ মোট৫৮০।রমরমিয়ে চলতে থাকে পূজার শো। কিন্তু একসময় দর্শকে ভাটা পড়তে থাকে। ২০১৪ সালে বিভিন্ন কারণে পূজা প্রেক্ষাগৃহে তালা ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য হন মালিকপক্ষ। 

জ্যোতিশ্রীতে প্রথমে একটি এবং পরে দুটি শো টাইম ছিল। পূজাতে ছিল তিনটে শো চলত। তবে দুই সিনেমাহলেই রথ,শিবরাত্রি এবং মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সারা দিনরাত ছবি দেখানো হত। অসামান্য স্মৃতিধর রূপকুমার বাবু সিনেমাহল ঘিরে তাঁর স্মৃতিকথা সোৎসাহে বলে যেতে থাকেন, "সিনেমাহল ব্যবসার প্রতি ছিল আমার তীব্র নেশা। কলেজ পাশের পর প্রথমে ঝাড়গ্রামে একটি হল করার জন্য জমি অব্দি কিনেছিলাম। শেষ অব্দি তা হয়নি। পরে গড়বেতার আমলাগোড়া অঞ্চলের গুঞ্জন টকিজ লিজে নিই।  কিন্তু সেখানেও সফল হতে পারি নি। শেষে পরিবারের জ্যোতিশ্রী খোলার উদ্দ্যোগ নিই"। আরও বলেন, " দুবছর জ্যোতিশ্রী টকিজ ফাটাফাটি চালিয়েছিলাম। তারপরে পূজা। কত মানুষ এসেছেন আমার বাড়িতে। সুরিন্রদর ফ্লিমসের সুরিন্দর সিংয়ের পরিবার সহ অন্যান্যরা। পূজা টকিজে সুপাস্টার দেবের ছবি চলত বেশি। একবার দেবের আত্মীয়রা একসাথে তেত্রিশ জন আসেন ছবি দেরখতে। কারণ দেবের মামাবাড়ি এই চন্রদ্রকোণা এলাকায। ভেঙ্কটেশ ফ্লিমস থেকে আমাকে তাঁদের আপ্যায়ন করতে বলা হয়। আমি যথাযথ ভাবে তা করেছিলাম"। পূজা টকিজে সবচেয়ে বেশিদিন চলা ছবি 'লাঠি',টানা ছ'মাস চলেছিল। 'সাথী' সিনেরমাও চলে ছ'মাস। এই প্রসঙ্গে রূপাুমার বাবু জানালেন, "একবার পূজা টকিজে একটি আদিবাসী সিনেমা চালাই। ছবির নাম মায়া তুকারে ময়না মোরে। ওই সিনেমা দতেখার জন্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষজন বাস, লরি ভাড়া করে আসে বই দেখতে এমন কি সিনেমার নায়ক- নায়িকা আসেন এবং আমার বাড়িতেও ছিলেন। আমাকে নিয়ে একটা পোস্টারও করেন তাঁরা। সিনেমাহল ব্যবসা আমার রক্তে। পূজা চলাকালীন সারেঙ্গাতে ( বাঁকুড়া) 'ইন্দ্রনারায়ণ' নামের একটা হল লিজে নিই। সাথে বর্ধমানের মেমারিতেও নিই 'স্টার সিনেমা'। কিন্তু বেশিদিন চালাতে পারিনি"।


ভদ্রলোকের মুখে সিনেমাহলের কথা শুনতে শুনতে কখন সময় ছুটে যাচ্ছিল,খেয়াল করিনি। রূপকুমার বাবু ইম্পার ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি ছিলেন। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রায় সব প্রেক্ষাগৃহে ঘুরেছেন। টালিগঞ্জের অনেকের সঙ্গেই বেশ সখ্যতা তাঁর। তবে মানুষটি নিরহংকারী। রূপকুমার বাবুর ছেলে সুপ্রিয় বাবুরও সিনেমার বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা বললেন, তা ভীষণরকম সত্যি। তাঁর মতে মানুষ চিরকাল বিনোদনমুখী। সিনেমাহলে এসেও সিনেমা দেখতে চায়। কিন্তু গ্রামগঞ্জের মানুষের মতো করে তৈরি করা ছবি আজকাল কোথায়। টিকিটের মূল্য, ও টি টি প্ল্যাটফর্মে যাই হোক হলে বসে সিনেমা দেখার মতো সিনে প্রেমী আজও আছে কিন্তু সিনেমা নেই। তবে শেষে এই আলোও দেখা গিয়েছে তাঁর কথায়," আবার সবকিছুতেই মানুষ পুরানো স্বাদ ফিরে পেতে চাইছে। হয়তোে সেই সূত্র ধরে হলমুখী হতেই পারে একদিন আবার"।


তথ্যঋণঃ–

শ্রী রূপকুমার গোস্বামী, চন্দ্রকোণা

শ্রী সুশান্ত সৎপতি, চন্দ্রকোণা

শ্রী সুপ্রিয় গোস্বামী, চন্দ্রকোণা



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ২০

  পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ২০ রূপছায়া টকিজ – বালিচক শ্রীজিৎ জানা সিনেমাহলে প্রবেশের আগে, এক প্রস্থ অন্য কথা হোক। আরে মশাই!...