Tuesday, 5 December 2023

রবীন্দ্র পরম্পরা // ই-কোরাস ৪৭


 

রবীন্দ্র পরম্পরা

পর্ব - ৪৭ 

অস্তরাগে…

মহাশ্বেতা দাস

          

       " মরণ রে, 

              তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।

            মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,

       রক্ত কমলকর, রক্ত-অধরপুট,

       তাপবিমোচন করুণ কোর তব

           মৃত্যু-অমৃত করে দান।

           তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।।"

    

  মৃত্যু সম্পর্কে নির্মলকুমারী মহলানবিশকে রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই বলতেন……

 

   ‘‘মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোন মানে নেই। আর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে জীবনকে না দেখলে অমৃতের সন্ধান মেলে না। এই জীবন মরণের খেলা দিয়েই জগৎ সত্য হয়ে উঠেছে।’’ 


    ১৯৪১সালের ২৯শে জুলাই বিকালবেলা,  জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রোগশয্যায় শায়িত কবি। শিশুকাল থেকে বহু স্বজন-আত্মীয় বিয়োগের সাক্ষী উনি। অনেক ছোট বয়সে মাকে হারানো, পরে একে একে নতুন বৌঠান, একাধিক সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, পত্নী বিয়োগ... অজস্র মৃত্যু  দেখেছেন, যন্ত্রণা পেয়েছেন। এখানেই শেষ নয় জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও একমাত্র দৌহিত্রকে হারানোর যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়েছে। তাই হয়তো দৃপ্ত স্বরে বলতে পেরেছিলেন….


 "করি না ভয় তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া,  

      দাঁড়াবো আসি তব অমৃত দুয়ারে।" 


    দূরদ্রষ্টা কবি আজ বুঝতে পারছেন আজ সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে নিবেদন করার সময় আসন্ন। সব ব্যথিত পূজার সমাপন হতে চলেছে। 

        

   "আর নাই রে বেলা, নামলো ছায়া ধরণীতে।

    এখন  চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে।"


  এবার "অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা"            এতদিন যা বেদন-ডোরে বাঁধা পড়েছিল তা  আজ "প্রকাশের লাগি"  যাতনা দিচ্ছে কবিকে। আর সেই যাতনা থেকেই অসুস্থ কবি একের পর এক কবিতা উপহার দিয়ে চলেছেন আমাদের! জীবনের একেবারে শেষলগ্নে রোগশয্যায় শায়িত, অসুস্থ কবি  অসুস্থতার কথা একেবারেই বলতে নারাজ ।  জীবনের এই গভীর কষ্টের মধ্যে তাঁর লেখনী যেন আরও গতিময় হয়ে উঠেছে। তিনি বলতেন…. 



   ‘‘জীবনের গভীর দুঃখের সময়ই দেখি লেখা আপনি সহজে আসে। মন বোধহয় নিজের রচনা শক্তির ভিতরে ছুটি পেতে চায়।’’ 

   

    তখনও তাঁর খুব ইচ্ছে করত নিজের হাতে কলম নিয়ে লিখতে… কিন্তু খাতা নিয়ে লিখতে শুরু করলে, একটু পরেই হাত কেঁপে পেশি শিথিল হয়ে পড়ত। অগত্যা…. কবি বলে যান আর রাণী চন্দ খাতায় লিখে রাখেন।  

    

    আজও (২৯শে জুলাই, ১৯৪১সাল) মুখে মুখে বলে গেলেন কবিতা…. খাতায় লিখে রাখলেন রাণী চন্দ। এরপর রাণী চন্দের হাত থেকে খাতা নিয়ে নিজেই সংশোধন করলেন। রসিকতাও বাদ গেলনা… উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বললেন…. "ডাক্তাররা বড় বিপদে পড়েছে। কতভাবে রক্ত নিচ্ছে, পরীক্ষা করছে কিন্তু কোন রোগই পাচ্ছে না!  এ তো বড় বিপদ ডাক্তারদের! …. রোগী আছে, রোগ নেই।"


       তবু….. চিরকাল ডাক্তারদের ছুরি কাঁচির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এসেছেন কবি। আজ তাই  অপারেশন নিয়ে বেশ বিমর্ষ। বললেন,…. "যখন অপারেশন করতেই হবে তখন তাড়াতাড়ি চুকিয়ে গেলেই ভালো।" রবীন্দ্রনাথ জানেন না আগামীকালই তাঁর অপারেশন হবে। ডাক্তার সত্যেন্দ্রনাথ রায় গ্লুকোজ় ইনজেকশন দেওয়ার পর ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল।এদিন বিকেলে যে কবিতাটি লেখালেন রাণী চন্দকে দিয়ে….. 

 "শেষলেখা" কাব্যগ্রন্থের প্রায় শেষের দিকের কবিতা। কবি লিখলেন "দুঃখের আঁধার রাতি" কবিতাটি। তারপর আর একটি মাত্র কবিতা লিখে চিরদিনের মতো থেমে গিয়েছিল বিশ্বকবির কলম….


                  ………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

No comments:

Post a Comment

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...