Friday 29 September 2023

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা // ই-কোরাস ৬

 




পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৬

শ্রীমা চিত্র মন্দির,  মলিঘাটী, ডেবরা

শ্রীজিৎ জানা 



মল্লিক হাটি থেকে নাম হয় মলিঘাটী। কংসাবতী নদীর দক্ষিণ পাড়ের নামকরা জমিদার। বর্তমানে ডেবরা থানার অন্তর্ভূক্ত। ইতিহাস বলে কলকাতার মল্লিকবাজার এই মলিঘাটীর মল্লিক জমিদারদের মালিকানার সাথে যুক্ত। পরবর্তী কালে রাধানগরের ছকুরাম চৌধুরী আত্মীয়তা সূত্রে মল্লিকহাটির জমিদারী লাভ করেন। শোনাযায় আশেপাশের অঞ্চল ছাড়িয়ে ওড়িশায়ও নাকি চৌধুরীদের এস্টেট ছিল। ছকুরাম চৌধুরীর পর জমিদার হন ঈশ্বর চৌধুরী এবং তাঁর পর জমিদারী সামলান বিষ্ণুপ্রিয়া চৌধুরী। এইখানে বলে রাখা যাক বর্তমান রাজনগর হাট এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়টির জমি বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী দান করেন। একদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামও ছিল রাজনগর বিষ্ণুপ্রিয়া প্রথমিক বিদ্যালয়। আজ সেই নাম অতীত।

চৌধুরী জমিদারদের অবদান কম নয়। বালিপোতার খেয়াঘাট চালু করা তাঁদেরই অবদান। বুধবার এবং রবিবার যে হাট বসে সেটিও শুরু করেন চৌধুরীরা। কিন্তু সিনেমাহলের সঙ্গে কী তাঁদের কোন লতায়পাতায় যোগ আছে? উত্তর হবে কস্মিনকালেও নেই। তাহলে শোনাচ্ছেন কেন হে বাপু? ফেনিয়ে বলা আমার অভ্যেস। তাবাদে মলিঘাটীর সিনেমাহলের গল্প শুনবেন অথচ তার সম্পর্কে জানবেন না এটা কেমনতর বিচার মশাই। অতএব আমায় থামায় কেডা! মলিঘাটী পৌঁছতে আপনাকে নাড়াজোল- মেদিনীপুর গামী সড়কের বালিপোতা বাসস্টপে নেমে দক্ষিণে কাঁসাই ডিঙিয়ে যেতে পারেন। অথবা ডেবরা থেকে লোয়াদা হয়ে আসতে পারেন। অথবা বেলতলা থেকে কল্মীজোড়ে কাঁসাই ডিঙিয়ে ধান্যখাল হয়ে আসতে পারেন।

জমিদারী আমলে মলিঘাটী ছিল পাঁচ ভাগে বিভক্ত– মলিঘাটী পশ্চিম, চক মহেশ,বাজারপাড়া,গড়মলিঘাটী এবং মুনিশা। আজও চক মহেশের অদূরেই রয়েছে মুনিষা নামের একটি সুবিশাল জলাশয়। এই চকমহেশ মৌজায় আজকের আলোচ্য সিনেমাহলের অবস্থান। চক মহেশকে অনেকে বলেন মোষকাটান অথবা মোষপুর। মোষপুরের বোমা, বারুদে নয়, মশলাদার আলুর পুরে ঠাসা। যে না খেয়েছে তার জীবনের বার আনাই বৃথা। আরো শুনুন মলিঘাটীর হাটের পরে এই সিনেমাহলকে কেন্দ্র করেই আলুর বোমা জনপ্রিয়তা পায়। বেশ তো মলিঘাটী হল,বোমা ফাটানো হল কিন্তু সিনেমাহল কোথায়? কেন এই মলিঘাটীর চক মহেশে। আজ তার কোন চিহ্ন নেই। সেদিনের সিনেমাহলের জায়গা বর্তমানে জঙ্গলাকীর্ণ।  জমির বর্তমান মালিক যুগল মহাপাত্র এবং কমলাবালা মহাপাত্র (হরিনারায়ণ পুর,ডেবরা থানা(। পূর্বেও উক্ত জমি তাঁদেরই মালিকানাধীন ছিল। কিন্তু সিনেমাহল তৈরির জন্য তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে নিরানব্বই বছরের লিজ নেন প্রয়াত বিমলকৃষ্ণ মান্না। তিনিই ছিলেন মলিঘাটীর জনপ্রিয় সিনেমাহল 'শ্রীমা চিত্র মন্দির' - এর প্রতিষ্ঠাতা। 


শ্রীমা চিত্র মন্দির সিনেমাহলের পথ চলা শুরু ১৯৮৩ সালে। দশ নম্বর ওয়াটারলু স্ট্রীটের একটি পৌরাণিক ডাবিং ছবি দেখানো হয় প্রথম।  দ্বিতীয় ছবিটি ছিল হিন্দি –' নাগচম্পা'। শ্রীমা চিত্র মন্দির কেন নাম দিলেন বিমলকৃষ্ণ বাবু? বিক্রমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের জীববিদ্যার তুখোড় স্যারের মাথায় কেন ঝোঁক চাপল সিনেমাহল করার? জানতে চান নাকি শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ করে ছেড়ে দেব। তাহা হইতেছে না। একবার যখন বাগে পেয়েছি কাতুকুতু বুড়োর মতো জোর করেই শোনাব। বিমলকৃষ্ণ বাবুর ছোটবেলার পড়াশুনা রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে। উচ্চশিক্ষা মেদিনীপুরে। পরে রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষা লাভ করেন। মা সারদা দেবী ছিলেন তাঁর পরম আরাধ্যা।  সেই পূজনীয়া মায়ের নামেই সিনেমাহলের নাম রাখলেন 'শ্রীমা চিত্র মন্দির'। বিমলকৃষ্ণ বাবু ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।  আর্ট বিষয়ে কোনরকম প্রথাগত বিদ্যা তার ছিল না। কিন্তু মাটির ঠাকুর গড়তে পারতেন তিনি মাচির দূর্গা প্রতিমা গড়ে মলিঘাটী চকে দূর্গাপূজার সূচনা তাঁরই হাত ধরে। এমনকি সত্তরের দশকে অমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে থার্মোকলের দূর্গা,মোমের সরস্বতী গড়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিমলকৃষ্ণ বাবু গ্রামীণ চলন্তিকা সিনেসাহলে সিনেমা দেখেই স্থায়ী প্রক্ষাগৃহ গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিনেমাহল গড়ার জন্য চক মহেশে জমি লিজে নেন। মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া তৈরী করেন সিনেমাঘর। 'শ্রীমা চিত্র মন্দির'- এর দর্শক আসন সংখ্যা ছিল চারশ। কৃষিজীবী এলাকা মলিঘাটী।  লোয়াদা আর সিঙ্গাঘাই ছাড়া কাছেপিঠে কোন ছবি দেখার সিনেমাহল ছিল না। স্বভাবতই যথেষ্ট সংখক দর্শক হলমুখী থাকত। বিশেষত সব্জীর মরসুমে সিনেমাহলে ভিড় থিকথিক করত। 

শ্রীমা চিত্র মন্দিরে সাধারণত তিনটা ও ছ'টার শো হত। অনেকসময় জনপ্রিয় ছবির ক্ষেত্রে দর্শকদের ভিড় দেখে চারটা, সাতটা ও দশটার শো চালাতেন হল মালিকরা। সিনেমাহল শুরুর প্রথম দিকে ফার্স্ট ক্লাসে টিকিট মূল্য ছিল ১ টাকা,সেকেন্ড ক্লাসে ৭৫ পয়সা এবং থার্ড ক্লাসে ৫০ পয়সা। পরবর্তীকালে বন্ধের মুখে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট মূল্য ৪. ৫০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। শুরুর দিন থেকে সিনেমাহলের সঙ্গে যুক্ত শংকর প্যোড়া জানাচ্ছেন,  " অনুসন্ধান,বৌমা প্রভৃতি সিনেমার ক্ষেত্রে দর্শকের চাপ এত হয় য়ে তিনটা করে শো করতে বাধ্য হতে হয়।" শঙ্কর বাবু সেইসব দিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে যান–" তখন বৃহস্পতিবার ছবি আনতে যেতাম কলকাতায়। শুক্রবার সেই ছবি হলে দেখানো হত। 'ছায়াবাণী', 'চন্ডী মাতা ফিল্মস ' থেকে ছবি আসত। ব্রোকার ছিলেন অমর রায়চৌধুরী। বেশ কয়েকটা ফিল্ম যেমন শহর থেকে দূরে,সাহেব,খেলার পুতুল।ফাটাফাটি চলে। ওড়িশার ডাবিং ছবি সতী অনসূয়া মারাত্মক ভাবে চলতে থাকে। কাঁসাইয়ের উত্তর পাড় পেরিয়ে চৌকা,মশরপুর ( ঘাটাল ব্লক),মনোহরপুর ( চন্দ্রকোণা ব্লক) থেকে পর্যন্ত দর্শক এসেছে এই হলে। ' 'শোলে' সিনেমা আমাদের এই সিনেমাহলে দু'সপ্তাহ করে তিনবার দেখানো হয়। আর প্রত্যেকবারে শো হাউসফুল হত"। এই সিনেমাহলের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে বিশেষ একটি দুঃখজনক ঘটনাও। বিমলকৃষ্ণ বাবুর পুত্র পার্থ মান্না জানালেন," তখন আমাদের হলে চলছে ডাবিং ছবি রামায়ণ। প্রতিটা শে'তে উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে। সকাল থেকে অনেক দর্শা চলে আসত। একদিন এত ভিড় হয় যে টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। সেই ভিড়ের মাঝে একটি বৃদ্ধা হঠাৎ 'হায় রাম তোমাকে আমি দেখতে পেলাম না' বলে অস্থুত হয়ে পড়েন। এমনকি মারা যান। এই ঘটনা সেই মুহুর্তে খুব বিচলিত করে সবাইকে"।


সিনেমাহল চলছিল আপন ছন্দেই। লাভ লোকসান মিলে মোটামুটি পুষিয়ে যাচ্ছিল মালিক পক্ষের। হঠাৎ সিনামাহলের মেসিনপত্র চুরি হয়ে যায়। তখন হলে চলছিল বিদ্রোহী সিনেমা। হল বন্ধ রাখতে বাধ্য হতে হয়। অনেক চেষ্টায় মেসিনপত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয় কিন্তু তার পর থেকেই হলের বাজার নিম্নগামী হতে থাকে।একসময় বালিচকের 'রূপছায়া' সিনেমাহলের মালিক সমর সিংহকে এই হল লিজে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরাও সেভাবে চালাতে পারে না। অবশেষে ১৯৯৩ সাল নাগাদ শ্রীমা চিত্র মন্দিরের পথ চলা থেমে যায়। বর্তমানে সিনামাহলের জন্য লিজ নেওয়া ৬২ ডেসিমাল জমি জমির মালিককে চুক্তি মোতাবেক ফিরিয়ে দেন মানা পরিবার। শ্রীমা চিত্র মন্দির একন অতীত ইতিহাস। মলিঘাটী বাজারে শুধুমাত্র সেইদিনের সিনেমাহলের গল্পগাথা কান পাতলে শুনতে পাবেন।


তথ্যঋণ : —

শ্রী শঙ্কর প্যোড়া, মলিঘাটী।

শ্রী পার্থ মান্না  মলিঘাটী

.................................




সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

1 comment:

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...