রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ২৬
ছোট প্রাণ ছোটো ব্যথা
মহাশ্বেতা দাস
মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়ের মেলবন্ধনেই বিশ্বের সৃষ্টিসৌন্দর্য্য সম্পূর্ণতা পায়। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা থেকে প্রকৃতিকে যতখানি অন্তরঙ্গতার সঙ্গে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করার জন্যই হয়তো সাধারণ মানুষকে তেমনভাবে পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। যেদিন কলকাতায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপে ঠাকুরবাড়ির লোকজন দশ বছরের রবিকে নিয়ে পেনেটিতে ছাতু বাবুর বাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেদিনও কাছে পল্লীগ্রাম থাকা সত্ত্বেও যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। জীবনস্মৃতিতে তাই লিখেছেন - "আমরা বাহিরে আসিয়াছি কিন্তু স্বাধীনতা পাই নাই"। সেই অভাবনীয় সুযোগ এবার ধরা দিল ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির কাছে। বিলেত থেকে ফিরে আসার দুই মাসের মধ্যেই জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করে উত্তরবঙ্গে চলে যেতে হলো তাঁকে। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি হিসেবে চেনা জানা রবীন্দ্রপ্রেমীদের কাছে এই ঘটনা খাপছাড়া মনে হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাই…. রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও তাঁর সহজ বুদ্ধি এতো প্রখর ছিল যে তিনি আশ্চর্য্য দক্ষতার সঙ্গে এই নূতন কর্তব্যকর্মকে মানিয়ে নিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের বয়স এখন ত্রিশ বছর। বাস্তব প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের সান্নিধ্য লাভ এমন নিবিড়ভাবে চেনা জানার সুযোগ এর আগে তিনি পান নি। তাই রবীন্দ্রজীবনে এই ঘটনা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ এবার তিনি বঙ্গপ্রকৃতির মাঝে সুখ দুঃখ হাসি কান্নায় ভরা সাধারণ মানুষের জীবন কে অন্তর দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন যার ছাপ রেখে গেলেন পরবর্তী লেখনীগুলিতে।
ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটি প্রথম থেকেই স্বভাব কবি। পরবর্তী ক্ষেত্রে নাটক, উপন্যাস, পত্র সাহিত্যের নমুনা বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে ক্রমশঃ সমৃদ্ধ করেছে। এবার তাঁর লেখনী স্পর্শেই বাংলা সাহিত্যের এক নূতন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। জন্মদিলেন সার্থক ছোটোগল্পের।
১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১সাল কে হিতবাদী ও সাধনা পত্রিকার যুগ বলা হয়। পত্রিকায় লেখা দেওয়ার তাগিদে রবীন্দ্র লেখনীতে এবার যেন নূতন জোয়ার এলো। একের পর এক সৃষ্টি হতে থাকলো ছোটগল্প…. নূতন নূতন কাব্য কবিতাও জন্ম নিলো সমধারা বেয়ে।
"ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।
ছোটো প্রাণ,ছোটো ব্যথা,ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি' মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।"
জমিদারি দেখাশোনার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়। এভাবেই পরিচয় হয় গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন চর্যার সাথে। পল্লীগ্রামের সাধারণ মানুষগুলিই হয় ছোটগল্পের পাত্রপাত্রী। পল্লিজীবনের বৈচিত্র্যময় রূপ এবং সেখানে অবস্থিত সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, আনন্দ বেদনা এসবই ধরা পড়ে ছোটগল্পে। এর আগে কেউ বাংলা সাহিত্যে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না নিয়ে লেখনী ধারণ করেননি। সেদিক থেকেও রবীন্দ্র প্রতিভা বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এলো নূতন দিশা আর তাই রবীন্দ্র পরবর্তী লেখকগণ বাংলা সাহিত্যের যে শাখা নিয়েই সাহিত্য রচনা করুন না কেন…. সেদিকেই রবীন্দ্র প্রতিভার দাঁড়িয়ে রইলো হিমাদ্রিচূড়ার মতোই যা অনতিক্রম্য। যাইহোক একদিকে প্রকৃতির সহজ প্রসন্ন প্রকাশ আর একদিকে জীবনের আন্তরিক উপলব্ধি গল্পগুলিকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
শুধুমাত্র ছোটগল্পই নয় ১৮৯৩ সালে "এবার ফিরাও মোরে" কবিতাতেও নিঃস্ব, অবহেলিত মানুষের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশিত হয়েছে।
"নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে,
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে,
মরে সে নীরবে! এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা, এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে-
মুহূর্ত্ত তুলিয়া শির একত্র দাড়াও দেখি সবে!"
১৮৯৫ সালে লেখা "দুইবিঘা জমি" রবীন্দ্র লেখনীর আর এক অনবদ্য সৃষ্টি… বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবিতা যেখানে এক ভূমিহীন কৃষকের জন্যে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলা হয়েছে।
দেনাপাওনা, পোস্টমাস্টার, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা প্রভৃতি গল্পগুলি তৎকালীন পল্লী সমাজচিত্রের দলিল হয়ে সাক্ষ্য বহন করে। দেনাপাওনা গল্পের নিরুপমা অথবা পোস্টমাস্টার গল্পের রতন এরা কেউ আমাদের অচেনা কেউ নয়,আমাদের পাড়াঘরে ঘুরে বেড়ানো অতি সাধারণ চরিত্র। ক্ষুধিত পাষাণ গল্পের মেহের আলি যখন চিৎকার করে বলে..… "তফাত যাও তফাত যাও" …..তখন সে আমাদেরকে মোহান্ধকারের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে বাস্তবের সূর্যালোকে এনে হাজির করে। ক্ষুধিত পাষাণ গল্পের মেহের আলি প্রকৃত পক্ষে বাস্তবের ঘণ্টাধ্বনি। তার কথার মধ্যে দিয়ে গল্পকথক পাঠকদের জানিয়ে দেয় যে এই চলমান জগতে কিছুরই স্থায়িত্ব নেই। রাতের অন্ধকারের মতোই অন্ধমোহে মানুষ ঘুরে চলেছে দিন রাত অলীক আকাঙ্ক্ষার পিছনে। মেহের আলি বারে বারে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে বিহানের অস্পষ্ট আলোকোদ্ভাসের মধ্যে চিৎকার করে উঠেছে ‘তফাৎ যাও'। তফাতে না থাকলে যে মোহান্ধকারের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে! সোনার হরিণের মোহে সীতাকে হারানোর মতোই আমরা আমাদের অস্তিত্বকে যাতে হারিয়ে না ফেলি, মেহের আলি তাই সতর্ক করে বলে ওঠে—‘সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়'।
ছোটগল্পগুলি শেষ হয়েছে অতৃপ্তি নিয়ে। গল্পের শেষে এই অতৃপ্ত মনই পাঠককে ভাবনার জগতে আচ্ছন্ন রাখে.… পাঠককে দিয়েই মনে মনে লিখিয়ে নেয় আরও কয়েকটি লাইন।
সুভা, অতিথি, ছুটি… প্রভৃতি গল্পগুলিতে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে না আছে বর্ণনার আতিশয্য না আছে ঘটনার ঘনঘটা। অভাব যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষের জীবনযাত্রার কথাই ছোটগল্প গুলিতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায় পাই সেসময়ে রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য জমিদার কেউ ছিলেন না। পরশ্রমজীবি মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও পরিশ্রমজীবি মানুষের প্রতি দরদ…. এ শুধু বোধহয় রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব এবং সেখানে ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটির উদার মানবিকতাই প্রকাশিত হয়েছে।
…………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment