রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ১২
যৌবনের পথে
মহাশ্বেতা দাস
সারদাদেবীর মৃত্যুর পর থেকে ইস্কুল কামাইয়ের পরিমাণ বেড়েই চলল। মা - হারা ছোট ছেলে... তাই দিদি এবং বৌদিদিদের আদর এই বিষয়ে আরও ইন্ধন যোগাল। স্বাভাবিক ভাবেই এরপর ধীরে ধীরে ইস্কুলের সঙ্গে আর কোন সম্পর্কই রইলো না রবির।
সাহিত্য সৃষ্টির দক্ষতা ঠাকুর বাড়ির লোকজনের জন্মর্জিত ক্ষমতা। বড়োদাদা দার্শনিক এবং কবি। সেজদাদা বহু গুণের অধিকারী। আর রবির জীবনে পঞ্চম দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রভাব তো অপরিসীম। নানা কর্মদ্যোগ, স্বদেশী ভাবনা, সাহিত্য রচনা, গান, নাটক, ছবি আঁকা.... বিবিধ বিষয়ে উৎসাহী মানুষ তিনি। নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিয়েও আনন্দ পান তিনি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মদ্যোগে ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় গড়ে উঠলো এক সাহিত্যচক্রের আড্ডা আসর। যেখানে অক্ষয় চৌধুরী, বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো সেকালের বহু খ্যাতনামা ব্যাক্তিরা আসেন। ছোটবেলা থেকে নিজের পরিবারে এসব দেখেই বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই স্কুলের গণ্ডিবদ্ধ জীবন যেমন করে তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে নি ঠিক তেমনই সিলেবাসের বাঁধাধরা পড়ার মধ্যেও নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেননি তিনি। মনের সুখে বাংলা বই, পত্রিকা.... হাতের কাছে যা পান তাই পড়ে ফেলেন। জ্যোতিদাদার সংগ্রহে ছিল প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ। বিশেষ মনযোগ দিয়ে পড়া শুরু হলো বৈষ্ণব পদাবলী। বিদ্যাপতি রচিত মৈথিলি পদ গুলি কৈশোর থেকে যৌবনের পথে পা বাড়ানো ছেলেটির মনযোগ বেশী করে আকর্ষণ করত। এছাড়াও জ্যোতিদাদা পিয়ানোতে সুর তুলেন আর রবির ডাক পড়ে সেই সুরে কথা বসানোর জন্য। পিতার সাথে গঙ্গায় বোটে বেড়ানোর সময় হাতে পেলেন গীতগোবিন্দ কাব্য। জয়দেবের কাব্যের সবটা বুঝতে না পারলেও ছন্দ ও কথা মিলেমিশে রবির মন ভরিয়ে তুলেছিল। এইভাবে বই পড়া, কবিতা রচনা এবং গান গাওয়ার মধ্যে সেদিনের দিনগুলিতে খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের স্বাধীনতা ও আনন্দের বিষয়।
এর মধ্যেই ঘটে গেল আর এক কান্ড। বাড়ির বড়োদের মনে হল.... ভাই-বোনেরা মিলে ঠাকুর বাড়িতেই লেখকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়! প্রত্যেকেই কম বেশী লেখালেখি করেন। এছাড়া ঠাকুরবাড়ির সাহিত্যিক আড্ডায় যেসব বন্ধুবান্ধব, খ্যাতনামা ব্যাক্তিরা আসেন... তাদের কাছ থেকেও লেখা জোগাড় করে যদি একটা মাসিক পত্রিকা বের করা যায়! যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় সেবছর শ্রাবণ মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। মাসিক পত্রিকাটির নাম দেওয়া হল "ভারতী"।
রবির বয়স তখন ষোল। ভারতী পত্রিকার আবির্ভাবে রবির লেখার আগ্রহ বেড়ে গেলকয়েক গুণ। স্বাভাবিক ভাবেই ঠাকুর বাড়ির ছোট ছেলেটির লেখনী স্পর্শে সৃষ্টি হতে শুরু করল অজস্র লেখা। ভারতী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় "ভিখারিনী" গল্প দিয়ে শুরু।" করুণা" উপন্যাসটিও এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও ভারতী পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ দেব। এই প্রচ্ছদ চিত্রকে উদ্দ্যেশ্য করে লিখেছিলেন "ভারতী" নামক কবিতা।
আজও আকাশে মেঘ দেখা দিলে... রিমঝিম করে বৃষ্টি শুরু হলে বাঙালির আবেগঘন মন গুনগুনিয়ে ওঠে....
"শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা
নিশীথ যামিনী রে
কুঞ্জ পথে সখী কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে...."
ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর ঢঙে মাত্র ষোল বছর বয়সেই ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটি লিখে ফেললেন " ভানুসিংহ" ছদ্মনামে "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" । জীবনস্মৃতিতে এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন.... "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে।..... একটা শ্লেট লইয়া লিখলাম"....
" গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে
মৃদুল মধুর বংশী বাজে,
বিসরি ত্রাস লোক লাজে
সজনি আও আও লো।"
………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - সম্পাদক
ঠিকানা -সুরতপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614
No comments:
Post a Comment