Monday 22 June 2020

e-কোরাস ৩৪ // তপনজ্যোতি মাজি এর কবিতা





তপনজ্যোতি মাজি এর কবিতা
১.
ঈশ্বরীকে নিবেদিত

রাত্রি  ন টায় ঈশ্বরী কবিতা পড়ছেন। কৃষ্ণা বসুর 'রাধিকা সংবাদ'।
তরল আলো গাঢ় হয়েছে যেখানে ঘোলা জলের মতো ঈশ্বরীর পা
দুটি ঝুলছে অনাবৃত।

স্বেচ্ছাচারী মেঘে সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছে অকস্মাৎ। আবহাওয়ার বৈশাখী
আবেগ। কুড়িয়ে পাওয়া আর্দ্র বাতাসে ঈশ্বরীর সমুদ্র  রঙ ঘুম ফ্রকের
বোতাম দুটি খোলা।

 নির্মাণ রেখার উল্টোদিকে বসে আছেন অক্ষর পুরুষ। তাঁর দৃষ্টি নক্ষত্রে
 নক্ষত্রে খুঁজছে শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়া জীবনানন্দের অমুদ্ৰিত কবিতার
 ধূসর জীবাশ্ম। ঈশ্বরীর

 ঈশ্বরীর ওষ্ঠে রাধিকার অভিমান কফি রঙের মতো গাঢ়।  ঈশ্বরী নারীবাদী
না হলেও নারীর স্বাভিমানে বিশ্বাস করেন। তাঁর  ট্রিমড চুলে রাত্রির বিষন্ন
নিভৃতি ও অন্ধকার।

অক্ষর পুরুষের কণ্ঠে জর্জ বিশ্বাসের ভঙ্গিতে গাওয়া রবীন্দ্রগান। বাতাসে
সুরের কম্পন। হরিনের জলপানের মতো আওয়াজ হলো কোথাও।  ঈশ্বরী
জানেন এই সময়টি চা পানের।
                      .......................


২.
বিনির্মাণ

বারোটা দু মিনিটে নিভে যাওয়া আলো জ্বলে যায়
শুরু হয় বিনির্মাণ।
কে কার শয্যা ভাগ করে
এক বুক নিথরতা নিয়ে নদী উঠে আসে বালি পায়ে
চুপি চুপ।

শব্দের  রঙ বদল হয়
নীল হয়ে যায় সবুজ, লাল স্থিমিত গোলাপী
রঙিন মাছদের মতো ডুব সাঁতার দেয় দু একটি তৎসম শব্দ।
বোতাম খোলা ঘুমফ্রকে ডুবো পাহাড়ে জলজ সবুজের
ঘ্রান নেয় ভিনদেশি ডুবুরী।

আকস্মিকতার স্পর্শে ঘূর্ণায়মান গোলকের কেন্দ্রবিন্দু বদল
হয় মুহূর্ত সময়।
অযাচিত প্রজ্ঞা না বোঝার স্থূলতা ঘোলা জলে মাছ ধরে শিকারী
বকের মতো।
এই সব জেনেও শব্দরা অন্বেষা সন্ধানী।
দানবিক ক্যানভাসে প্রেম সৌর বিন্দুর মতো
অভিমানী চাদরে মুখ ঢেকে ঘুমায়
সারারাত।

আলো জ্বলে জলযানের দোতালা কেবিনে
কখনো গান কখনো কবিতা শুনতে শুনতে
নির্জন নাবিক গভীরতা মেপে তটবর্তী  করে পালতোলা
জাহাজ।
ঘুমের আগে উদ্ধৃতি  চিহ্ন বসিয়ে চাঁদ চুপি চুপি বলে
পাখির জাগার সময় হলো পর্ণ ছায়ায়।
               .......................


৩.
আকাশ

সীমাহীন বিশালতা। তোমার উদারতা টেবিলের উপরে রাখা প্রিয়
পেপারব্যাক, প্রতিদিন একটু একটু করে পড়ি।  তোমার ঝড় বৃষ্টির
উপাখ্যান , তোমার নীল সরোবর , তোমার নীরবতা , সব।

কাচের খেলনা প্রতিটি জীবন।  ভেঙে খান খান হয়  বিচিত্র অভিঘাতে।
আমরা হয় ব্যর্থ প্রেমিক অথবা ব্যর্থ সংসারী। আমাদের সাফল্য , উচ্চতা
এমনকি অহংকারও  কাচের নির্মাণ। অনিবার্য ভঙ্গুর।

তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছা হয় ভোরবেলা কিংবা  মধ্যযামে। আলো হয়ে উঠার
সন্ধিক্ষণটি বড়ো পার্থিব। একটি মানুষের বোধ জেগে উঠছে, ঘুম ভাঙছে
সুপ্ত মনুষ্যত্বের I খুলে যাচ্ছে এ আমির আবরণ।

মধ্যযামে তুমি দার্শনিক কিংবা স্বপ্নসঙ্গী। বিপুল প্রজ্ঞা অথচ নীরব। দূরতম
হয়েও অন্তরতম I এমন প্রেম যা অনুভবে আর্দ্র করে হৃদয়।  এমন সংগীত
যা অনিঃশেষ। একটি অন্তহীন কবিতার অক্ষর প্রকরণ।
                       ............................


৪.
মা

অক্ষর নিরাকার নয় I অথচ অনুভুতিটা আকারহীন।  চেতনালোক জুড়ে
জড়িয়ে আছো, অনশ্বর স্নেহ ও শুশ্রূষা। একবার বাতাস, একবার জল,
একবার আলো কিংবা মৃত্তিকা ভেবেও , মা বললাম স্বগত।

আমার  হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা থেকে  তুলে আনি বিন্দু বিন্দু বুদবুদ।
চাঁদের কপালে টিপ্ দেওয়ার মতো ইস্কুলবেলায় গরম ভাতে আলু। জ্বলন্ত উনুনের পাশে হাতে বোনা আসনে বসে
শ্লেটে লেখা অক্ষর।

 একটা নদী, একজন মা আমাদের মনের শিকড়।  ছড়িয়ে আছে অলক্ষে।
 যত্নে ধরে আছে বলেই শাখা প্রশাখাতে এত পাতা , এত ফুল , এত আলো।
পরিচর্যার নিরুচ্চার প্রকৃতি। মনোময় চিরহরিৎ ভূমি।

 ধ্যানের উপলব্ধি থেকে  মন্ত্র তুলে আনি। পাঠের সুতোতে গাঁথি সমস্ত অক্ষর।
 আকাশ  আলো  জল  মাটি সব মিশে আছে তোমার শরীরে।  প্রথম ধারণভূমি
 তুমি, প্রথম যত্নভূমি তুমি , আমার প্রথম উচ্চারণও তুমি।
                                  .......................


৫.
প্রত্যর্পণ

হাতের তালুতে মুগ্ধ উষ্ণতা।
প্রত্যর্পণে কি দেবো তোমাকে? দৈবসময়ে শ্বাসরুদ্ধ যবনিকা
সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো তীর্থপর্যটক। মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি ধাতব
ইংগিতে বললো , ঈশ্বর নিরুদ্দেশ।

আমি জন্মঅবিমৃষ্যকারী ও প্রান্তিক
আমার পায়ের নিচে পাথরের ক্লীবতা,
মস্তিষ্কে না খেতে পাওয়া মানুষের কান্না ও সংগ্রাম।
আমি কি দৈবগতপ্রাণ হতে পারি ?

জীবনের মুখ্য বিবেচনা নিয়ে তর্ক হলো খুব।
নিশ্ছিদ্র কক্ষ থেকে চুরি যায় প্রাণ
প্রেম আজও দূরতম গ্রহ
অঙ্গের  নামাবলী জানে প্রকৃত প্রতারক কে।

তালুতে মেখেছি উষ্ণতা
শাপভ্রষ্ট দেবতা।
 তোমাকেই মানবী ও দেবী ভাবি ,
পূজা ও প্রেমের গানে  প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে
উৎসব।
তখন বিনত বলি প্রেম হলো
হিরণ্ময় আলো।
অন্ধকারে প্রতিমার রূপ।
                        .............................


৬.
মন্থন

আজ সারাটি মধ্যাহ্ন মন্থন করে অনির্বচনীয় যা পেয়েছি, বিন্দু বিন্দু
করে মিশিয়ে দিই জলের শরীরে। জল ঋতুমতী।
বোধিচিহ্ন বুকের
 প্রান্তরে নিয়ে নিরাবরণ রূপসী।

 সংস্কারশূন্য প্রান্তজন আমি। নিদাঘ ও বর্ষা পার হয়ে একা  দাঁড়িয়েছি
 হরিৎ বেদনার আবহে। আমাকে রিক্ত করো, নিঃস্ব করো, স্থবির এবং
 অপ্রয়োজনীয় করো আনন্দ ইচ্ছায়।

 আমার পূর্বকাল নেই। আমার  উত্তরকাল নেই। অনন্ত করুনা মেখেছি
 হৃদয় অবধি।  বিরল আশ্লেষে অনুভব করেছি তোমার সান্নিধ্যের থেকে
 সমৃদ্ধতর কিছু নেই ধারণ করার মতো৷

 এই উদ্বোধন সন্ধ্যায় জলের চুম্বনে আর্দ্র ওষ্ঠদুটি বৃষ্টিবর্ন পাতার মতো
 কিছু বলতে চাইছে। সময়কে থামিয়ে দিয়ে এক  জন কবি  রচনা করে
 শ্লোক। আমি ধারণ করলাম রক্ত পলাশ।
                         .......................


৭.
রাগ

রাগ বললেই দ্বন্দ্ব।
কোন রাগ ?
মনের অসাম্য থেকে জন্ম নেওয়া রাগ
নাকি শাস্ত্রীয় রাগ।

শাস্ত্রীয় রাগ মানে অবিচল অনুশীলন, শুদ্ধ সুরের বিস্তার।
আলো নিভিয়ে শুনি ,
কখনো ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ  সাহেব
কিংবা পন্ডিত রবিশঙ্কর।
সুরের রূপকথা।

অসাম্যের আবহে যে রাগ সেতো ঘূর্ণি,
ওলট পালট করে দেয় সব কিছু, এমনকি জলের নিরভিমান
 বুক।
ভেঙে চুরমার করে বিশ্বাস
প্রেম
প্রণয়
দাম্পত্যও।

রাগ মেঘমল্লারে বৃষ্টি নামে।
রূপকথা
রাগ পড়ে গেলে জল।
আস্ত একটা নদী
চাঁদনী  রাতের অভিসার।

আমার দ্বন্দ্ব কবে মুছে দেবে
রাগবিরহিনী রাই ?
                    ..............................


৮.
এবং অবশিষ্ট

ছাদের হাওয়ায় তোমাকে তোমার মনের কাছে রেখে যে চলে
গেলো, সত্যিই কি যেতে পারলো সে ? একে কি যাওয়া বলা
 যায় ?
এক একটা মুহূর্ত এক এক রঙের কৌটোতে ভরে সাজিয়ে রাখে
যে উন্মাদ, সে তো ইচ্ছাধীন নয়।  তার সঙ্গে ব্যবধান, অকল্পনীয় ,অসম্ভব।
চিঠি  শেষ করে  পুনশ্চ লিখে  ভুলে যাওয়া জরুরী প্রসঙ্গ লিখতো
কয়েক দশক আগের মানুষ। কি কথা লিখতে পারে নক্ষত্রহীন অন্ধ আকাশ ?
সমস্ত  কথা  উচ্চারিত হয়না এক জীবনে I অনুভব ছুঁতে পারে  রাত
পাখির ডানায় লেগে থাকা ঘুম। তোমার ইচ্ছাকে একবার পাখি হতে দাও।
 নির্বাক আরিকুরিয়ার সবুজ পাতারা  যে ভাবে জলের মূর্ছনা পেতো
 দহন বিকেলে, তোমার অজান্তেই কত মুহূর্ত নদী হয়ে আছে তোমার দশদিকে।
 তুমি এই সব নদীদের একদিন অবসরে  ডাকো। কথা বলে জেনে নাও
 কবে  জলোছ্বাসে  তোমার ঘুমের মধ্যে  অবাধ্য পুরুষ  হয়েছিল মনীশ নক্ষত্রটি।
                           .........................


৯.
নির্জনবর্ণ

নির্জনবর্ণ মন ঋণ করি।

প্রবাসী ও ঋণী
আমার হলোনা গৃহসুখ।
কেবল ফেরি করি
এবেলা ওবেলার রোদ।

তুচ্ছ নয় কেউ
সপ্তপর্ণী হতে পারে চক্ষু পল্লব।
তোমার গ্রন্থনা শুনি
পূর্ণ সভগৃহে।

আমাকে ঋণী রাখো
অপ্রেমে থাক তুচ্ছ ভ্রান্তি গুলি।
দ্যাখো, উন্মোচন কাল
লিপি ও প্রস্তর।

স্পর্শ  দাও একবার
সব ধ্বনি প্রতিধ্বনিময় বলেছিলো কেউ।
ওম খুঁজি নাভিমূলে
পরান্মুখ মনে বাড়ে ঋণ।
             ........................


১০.
অঙ্গবাস

ইস্ত্রি করে নাও অঙ্গবাস
পাহাড়ে  বৃষ্টি  ভোরবেলা
মেঘ পরিযায়ী।

রোদ্দুরে শুকোয় দস্তানা
ঝির ঝির শব্দ কানে আসে
হৃদয়ে  মূর্ছনা।

নির্মম গ্রীষ্মে পুড়ে কৃষ্ণ ত্বক
সন্ধ্যার আগে কথাকলি মেঘ
 দৈব প্রণয়।

 সংকটে  অপরাজেয় প্রেম
 শ্রম ও শ্রমণে তুচ্ছ ব্যবধান
 অক্ষর সংগীত।

 স্নানঘরে  জলের  সমারোহ
 ভেজাচুলে শিবরঞ্জনী রাগ
 ধ্রুপদী আলাপ।

 প্রসারিত শাখায় সবুজ পল্লব
 গৃহ ও বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের গান
 প্রাণের আরাম।

পূর্বাপর মুছে দিলো কণ্ঠস্বর
অন্যমনস্ক মনে তুমি দেবী
কবির প্রেমিকা।

 ইস্ত্রি  করে  নাও  অঙ্গবাস
 কবিতারা  ধাবমান  ট্রেন
 ছায়া চরাচর।
                    .......................




সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
তুলিতে - দেবাশীষ সোঁ
ঠিকানা - সুরতপুর, হরিরামপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
পশ্চিমবঙ্গ ৭২১২১১
কথা - 9434453614


4 comments:

  1. চমৎকার।তপনজ্যোতিকে আমার হার্দিক প্রীতি ও অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. চমৎকার।তপনজ্যোতিকে আমার হার্দিক প্রীতি ও অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  3. Thank you so much for uploading these creations of our beloved Sir Tapan babu.
    It's so nostalgic..Pronam Sir.

    ReplyDelete
  4. Apurba Maity (Year 1995 HS batch)

    ReplyDelete

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...