Sunday 31 December 2017

e-কোরাস তিন এসো গল্প পড়ি

        






    বেশ মনে পড়ে; শৈশবে উনুনের পাশে চাদর মুড়ি দিয়ে ঠাম্মার গল্পের কথা।আগুন মোজে আসতো শীত লাগতো বেশ আর গল্পের শেষটুকু শোনার জন্য সবাই আরো উনুনের কাছে আসতাম আর ঠাম্মা বলো উঃ তোরা একটু সরে যায়, না হলে আমি আগুনে জ্বলে মরবো তো। আর আমরা বলতাম তুমি আগে গল্প বলতো তারপর মরার কথা বলবে।
আমরা সবাই গল্প করার সময়কে হারিয়ে ফেলছি।আসলে মনের মানুষ না পেলে গল্প হয় না।
তাই কোরাসের মনের মানুষদের জন্য কোরাসের ছোট প্রয়াস।
গপ্প আর গল্প।

                                                                                                                                                                                                                     দুঃখানন্দ মণ্ডল                                                                                                          সম্পাদক,কোরাস



 সূর্যোদয়

তুষ্টি ভট্টাচার্য


  
রাত জেগে পড়াশুনো করে রজত। এক একদিন তো ভোর হয়ে যায় ওর পড়তে পড়তে। তাই বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে ও। সেই ছোটবেলাকার অভ্যেস এটা ওর। তাই কবে রজত সূর্যোদয় দেখেছে, মনে করতে পারে না। এরকম ভাবেই চলছিল। কিন্তু একদিন বাথরুমে যাওয়ার তাগিদে ওর ভোরে খুম ভেঙে যায়। তখন সবে আলো ফুটছে। দুএকটা কাকের হালকা ডাক আর একটা শিরশিরে হাওয়া। যদিও ও চোখ খুলতে পারছিল না ঘুমে, চোখ জ্বালা করছিল, তবুও কি এক খেয়াল বশত রজত ছাদে চলে গেল।
   সমস্ত পাড়া ঘুমোচ্ছে তখনও। আধো অন্ধকার আর আধো আলোর মধ্যে বাড়িগুলোকে কেমন যেন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। পাশের বাড়ির বুড়ি ঠাম্মার ঘুম ভেঙেছে মনে হচ্ছে। জলের বালতি নিয়ে সদরে জল দিচ্ছে এখনই! আস্তে আস্তে রজতের চোখ জ্বালা কমে আসছে। আলো ফুটছে একটু একটু করে। হঠাৎ পুবের আকাশটা কেমন লাল হয়ে এলো। আর ও কি! ও কি! একটা লাল টকটকে আলোর বল লাফ দিয়ে উঠলো কোত্থেকে যেন! এও সম্ভব! আস্তে আস্তে বলটা ওপর দিকে উঠছে আর ওর লাল রঙ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।
   একটা অদ্ভুত প্রশান্তি জুড়ে বসেছে এখন রজতের মনে। এতক্ষণ ওর ঘুমঘুম ভাবটা উবে গেছিল। আবার যেন শরীর জুড়ে ঘুম নামছে। মনে হচ্ছে এই ছাদেই শুয়ে পড়ে। কোনরকমে বিছানা পর্যন্ত এসে শরীরটাকে ছুঁড়ে দেয় রজত। তারপর চোখ খোলে সেই বেলা দশটায়। বাড়ি থেকে যখন বেরোল, তখন সূর্য প্রায় মাথার ওপর। একঝলক সূর্যকে দেখে নিয়ে রজত মনে মনে বলল, ‘আজ তোমার যে রূপ দেখেছি, তা আর কোনদিনই দেখতে চাইব না। একবারই অমন রূপ, অমন ইন্দ্রজাল দেখে হজম করা সম্ভব। স্যালুট তোমায়।‘
                                                                          ------------------

  বিশ্বাসঘাতক

  মিঠু রাজবংশী



ঈশ্বরের আজকাল আয়নার দিকে  তাকাতে ইচ্ছে করেনা আর। নিজের মুখ দেখলেই মুখে থুতু উঠে আসে। নিজেকে সামলাতে না পেরে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ঈশ্বর। 
তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে থতমত খেলো বিছানায় শুয়ে থাকা সুলগ্না। টেনে হিঁচড়ে নিজেকে কোনোমতে নামালো বিছানা থেকে। আয়নার ওপাশ থেকে ঈশ্বর দেখছে সুলগ্নাকে কেমন শরীরটাকে  মেঝেতে টানতে টানতে এগিয়ে  আসছে তার কাছে। ঈশ্বর জানে ও আয়নার সামনে আসবে না, নিজের মুখকে ঘেন্না করে ওর।
নিজেকে একটু সামলে সুলগ্নাকে জড়িয়ে  ধরলো এগিয়ে গিয়ে,
"তুমি আবার মিছিমিছি উঠতে গেল এত শরীর খারাপ নিয়ে?"
অনেকদিন পর সুলগ্না ওর বুকে মুখ গুজেছে, বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে ওর।
"কোন কুক্ষণে যে বাবা-মা আমার নাম রেখেছিল সুলগ্না কে জানে!
এই মানুষটাকে একটা সন্তান দিতে পারলাম না। আবার দু'বছর ধরে এত অসুস্থ। সারা শরীর জুড়ে  বিচ্ছিরি ফোসকা কোত্থেকে যে এলো, ডাক্তার ধরতেই পারে না, কি অসুখ! নিজের মুখ দেখলে ঘেন্নায়, ভয়ে মরে যেতে ইচ্ছে  করে। এই মানুষটার সারাটা জীবন তছনছ  করে দিলাম।"
একটুখানি খামচে ধরে ঈশ্বরের চোখের দিকে তাকায় সুলগ্না ,
" তুমি এভাবে কাঁদছো কেন?
আমার জন্য আর মায়া বাড়িও না,
এবার আমায় ছুটি দাও।"
ঈশ্বর চোখ বাঁধ মানছেনা জলের। বুকটা ব্যথায় ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, এই এক্ষুনি সুলগ্নার পা দু'খানি জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চায়। সব বলে দেয়। সব। বলে দেয় যে তিন বছর আগে বাড়িতে কাজ করতে আসা বিধবা সন্ধ্যাকে সে লুকিয়ে  বিয়ে করেছে সন্তান পাবার আশায়। একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে রেখে দিনের পর দিন আনন্দ  করেছে তারা। একবছর ধরে সন্ধ্যা তার ই নির্দেশে সুলগ্নার খাবারের মধ্যে একটু একটু করে স্লো পয়জন মিশিয়েছে। আর তারই ফলস্বরূপ  আজকে তার সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে মরণদায়ী ফোসকা আর অসহ্য যন্ত্রণা।
একমাস হয়ে গেলো, এখন সন্ধ্যার সামনে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজেকে চোরের মতো লাগে ঈশ্বরের। নপুংসক ঈশ্বর। সন্ধ্যার পেটে সন্তান আসছেনা দেখে দুজনে গিয়েছিল গাইনোকলজিস্ট এর কাছে। সবরকম পরীক্ষা নিরীক্ষার ডাক্তার জবাব দিয়েছেন, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ঈশ্বর।
'যে মানুষটার কোন দোষই ছিলনা , এতবড় শাস্তি পেল জীবনভর?'
ভাবতে ভাবতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে  ঈশ্বর। 
হঠাৎ পায়ের ওপর কিছু একটা ছোঁয়া পেয়ে সম্বিত ফিরল ওর। সুলগ্না এবার ওর পায়ে মাথা রেখে কাঁদছে, 
" তুমি সত্যিকারের ঈশ্বর।  আমার মতো অভাগাকে এভাবে  কেউ ভালোবাসে নাহলে।" 
ঈশ্বর পাথরের মতো দাঁড়িয়ে  আছে। যেমন করে দাঁড়িয়ে থাকে ঠাকুর ঘরের ঈশ্বর। ওরও কিচ্ছু করার নেই।              
                                            ------------------

 সত্যিকথার সঙ্গে

    সুকান্ত সিংহ


  
 



জুবুথুবু বসে আছে ছেলেটা।বাতাসের তাড়া খেয়ে বৃষ্টির ছাট ভিজিয়ে দিচ্ছে স্টেশন।  ভিজিয়ে দিচ্ছে ছেলেটাকেও। খুব ইচ্ছে হল রেনকোটটা এগিয়ে দিতে। কতই বা দাম। ভাবতে ভাবতেই ট্রেন এসে গেল। উঠে পড়লুম।
     ট্রেন ছাড়তেই মনে হল গরিবের একটু আধটু ভিজলে কিছু এমন কিছু ক্ষতি হয় না। অভ্যাস থাকা ভাল।
      মন শান্তি পেল!
                                                                       ----------




  শোক ও একটি আপেলের জীবনকাল

    মোহাম্মদ জসিম



পৃথিবী থেকে পালানোর ঠিক পাঁচ মিনিট আগে তিনি টের পেলেন তার বুকপকেটে একটিমাত্র চকচকে দশ টাকার নোট। ঘরবাড়ি কিংবা নিজস্ব মাটি তার কোনকালেই ছিলো না। যৎসামান্য যা কিছু উপার্জন সবই তিনি খরচ করে ফেলেছেন। তিনি পৃথিবী ছাড়ছেন একরকম পিছুটান ছাড়াই। অবশ্য স্বজন বন্ধু্দের সাথে তার যাবতীয় সম্পর্কের কথা যদি বাদ দেই তবেই।
দশ টাকা-তলানী হিসেবে টিকে থাকা চকচকে দশ টাকা এই মুহুর্তে তার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং মাথাব্যথার কারন। যৌক্তিক এবং যথার্থ উপায়ে তিনি এটিকে খরচ করে যেতে চাইছেন। ভিক্ষুককে দিতে পারেন-কিন্তু দিলেন না। অথবা খরচ না করলেও তো সেই অর্থে তেমন কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। খরচ করেই যাবেন।
অবশেষে তিনি একটি আপেল কিনলেন। পৃথিবীতে এখনও দশ টাকায় একটি স্বাস্থ্যবান আপেল পাওয়া যায় ভেবে মনে মনে বেশ আনন্দ পেলেন ভদ্রলোক। মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে তিনি সদ্য কেনা আপেলটিকে রাস্তায় ছুড়ে দিলেন-এবং আপেলটিকে ঘিরে মানুশের কাড়াকাড়ি ও কোলাহল দেখতে দেখতে চোখ বন্ধ করলেন।
পৃথিবী ত্যাগ করার কতক্ষন পরে তিনি পূনঃরায় চোখ খুলেছিলেন মনে করতে পারলেন না। ঘড়ি ব্যাবহার করে না এখানে কেউ। ইশ্বরের মুখোমুখি হলেন অল্প সময়ের মধ্যেই। ইশ্বর জানতে চাইলেন-মৃত্যুকালে আপেল কেনার রহস্য কি! লোকটি সহাস্যে জবাব দিলো-আমি আসলে জানতে চেয়েছিলাম একটি আপেলের আয়ুর তুলনায় মৃত মানুষের জন্য মানুষের শোক কতটা দীর্ঘস্থায়ী..
                                                                  ----------------

  জীবনের রঙ

  রিয়া চক্রবর্তী


বাড়ির সামনের গলি দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই বড় রাস্তা। রোজ ভোরে আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। সেখানে পাশাপাশি তিনটে দোকান। একটা ওষুধের দোকান, একটা জুতোর দোকান আরেকটা সোনার দোকান। দোকান তিনটের ভিন্ন রং আমি প্রতিদিন লক্ষ্য করি। দেখি হলুদ রঙের চকচকে ধাতুর মধ্যে লাল,নীল,সবুজ নানারঙের মূল্যবান পাথরের সাথে মিশে যাচ্ছে পাশের দোকানের চামড়ার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রক্তে, আর তাকে জীবানু মুক্ত করছে ডেটল। এইসবের ফাঁকে সেই মিঠে গোলাপি ক্যান্ডি ফ্লসের মতন আবছা স্বাদমাখা বাসের আগমন, আমার প্রতীক্ষার অবসান।
মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ছোট্ট বেলায় দাদুর হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম সারা কোলকাতা। পুরনো একটা দোকানে দাঁড়াতাম। দাদু গ্রামফোন রেকর্ডের পছন্দের গান কিনতেন। ভিক্টোরিয়াকে পেছনে ফেলে , নিউ মার্কেটের নাহুমের কেকের দোকানে আমার লাফালাফি সেরে , বিশাল গড়ের মাঠটাকে টা টা করে ,কালীঘাটের মন্দিরকে নমো নমো করে রসগোল্লায় মাখামাখি করে দাদু নাতনীর বাড়ি ফেরা। আবার কখনও কোন এক গরমের বিকেলে দাদুর সাথে উড়ে যাওয়া প্রিয় গড়িয়াহাটে। পছন্দের পুতুল, একটু দরকষাকষি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। জবজবে ভিজতে ভিজতে বেদুইনের রোল। রাতে বাড়ি ফিরে হ্যাচ্ছো হ্যাচ্ছো করতে করতে লুচি কাশ্মীরি আলুর দম আর কাজু কিশমিশে ভরা জন্মদিনের পায়েস। চমকে উঠলাম কন্ডাক্টারের চিৎকারে, “এল্গিন এসে গেছে কারা নামবেন নেমে যান”।
অগত্যা ফিরে এলাম আমার শৈশবের সবুজ রং গুলোকে হাত ছাড়িয়ে আমার বর্তমানের সদা ব্যস্ত জীবনে। এখন দাদু নেই তাই স্বপ্নজুড়ে দাদুর হাত ধরে ঘুরে বেড়াই। স্বপ্নের উপত্যকায় পাহাড়চেরা ঝর্ণা,মেঘ,ছোট্ট আমি ,দুষ্টুমিতে ছোটাছুটি এ পাড়া ও পাড়া। একটুকরো ছোটবেলার একফালি সোনালি রোদ ছড়িয়ে আছে এ শহরের পথে পথে, আরেক টুকরো আড়ি করে পাড়ি দেবে কোন অজানা পথে,হয়তো শহর থেকে দূরে।
এখন দিনগুলো বড় বেশি ধীর স্থির শান্ত। যেন কোন তাড়া নেই। এখন সূর্য ওঠার আগে উঠে পড়ি। আকাশের কোলঘেঁষে লাল, কমলা রঙের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। আবার কখনও কখনও এমন রাত আসে, যেসব রাতে, একলা চাঁদের পাশে লক্ষ কোটি চাঁদ জ্বলে ওঠে।রূপকথার গল্পেরা ঘুমের-পাশ কাটিয়ে চলে আসে আমার চোখের পাতায়, মনের রুপোলী খাতায়। গতকাল রাতেও এসেছে।অনেকটা ধুয়ে গেছে অবুঝ মন। ভুলে যেতে চেয়েছে গভীর কালো অন্ধকার ভয়ংকর সেই রাতগুলোর কথা। বর্ষার এখনও অনেক দেরী, তবুও মন আজ স্বচ্ছ টলটলে দিঘী। স্বচ্ছ জলে বারবার আনমনা অবগাহন। পলির মতন আনন্দ গুলো জমে মনের মোহনায়।
ভালোলাগার তুলিকে সাথে নিয়ে নীল রঙা রাতে সেই পলি সেঁচে চোখ আঁকে ভালোবাসা। আর ঠিক তখনই রাতের ঘাসের ওপরে শিশিরের চাদরের মতো একটু একটু করে রোদ পেয়ে মুছে যায় দিঘী। ভাললাগা,ভালোবাসার হাতধরে মনের মাঝে আবার কচি নরম ঘাসের সবুজ আস্তরন,যদিও এখন আর আগের মতো মেঘেরা নিজেদের রূপের বাহার দেখতে আসে না জানলার শার্সীর আর্শীতে। রাতের আকাশের প্রিয় তারাগুলো অপেক্ষায়,অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে যায় মন-চোখ। জীবনের নদী তিরতির করে বয়ে চলে। ইচ্ছেরা সব নিজের মতন এগিয়ে যায় সময়ের হাত ধরে বাঁধের পর বাঁধ ডিঙিয়ে। নরম রোদে মাঝে মাঝেই দাঁড়াই, কুশের আসন জলে ভিজিয়ে বসি, বুকভরে নিয়ে নিই বেল,গন্ধরাজ,খানিক আতর। রাঙিয়ে নিই নিজেকে শিমুল,পলাশের লাল রঙের সাথে। ভাললাগা জমে যায় মনের অসংখ্য অলিগলিতে। সন্ধ্যে বেলায় পাখিদের সাথে আমিও ফিরে আসি আমার প্রিয় ঘরে। মান অভিমানে একটা একটা করে নদী জন্ম নেয় আবার মুছে যায়। রোজ রোজ। মাঝে মাঝে। কখনও কখনও। নদী মোছে। আবার নদী আঁকি নতুন।পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ নীল জল। একা একা নির্জনে।
এখন একটুতেই নদী আঁকে মন।নীল রঙের সাথে মিশে হয়েছি নীল। যখনই নির্ভরতার হাত অবিশ্বাসের সাথে দূরে যেতে চেয়েছে ঠিক তখনই। তখন অনেকটা মন জুড়ে একা। পুরনো নদী সব ধুয়ে মুছে গেছে। এক আকাশ অভিমানের পরে তুলি হাতে বসি। আরেকটা আঁকা হবে নিশ্চিত। ঠিক তখনই মনের কৃষ্ণচূড়ায় ডেকে ওঠে চিরচেনা সুর। আর সাথে সাথেই নদী মুছে যায়, সাথে ধুয়ে নিয়ে যায় মনখারাপের আকাশ। একরাশ অভিমান। জলের মনে নদী আছে, নদীর জলে নীল। কথার ভেতরে শব্দ আছে,আবার শব্দের আছে মান। মান,অভিমান, চোখ ছলছল, আর্শি নগর, মনের ভেতর ঘর।
আবার কখনও গভীর রাতে চাঁদের আলোয় ঘর নিকিয়ে, ঘাস বিছানায়, লালচে রঙা আলো বেয়ে বয়ে যায় অপেক্ষার প্রহর। অপেক্ষার মন, আরেকটু রাঙিয়ে নেয়, রঙ ঝকমকে,খুশী ঠিকঠিক, একটু বেঠিক নেই। ঠিক-বেঠিকের হিসেব কষে হিংসুটে কাদাখোঁচারা। আমি তো মন পেতেছি, রোদ মেখেছি। হাতের বন্ধু মুঠি আছে, মুঠির দোসর আঙুল। সুখ মেখেছি আঙুলময়। আবার রপকথার রাস্তায় ঘুরে বেড়াই সেই ছোট্টবেলার খুব আদুরে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে , আর সাথে থাকে ভালোবাসা।
অনেক কথার দোষ। অনেক কথার দোষ আমার,তখন রোষ হয় ভালোবাসার। আবার কথাতে, কোন কথাতে আবার ব্যাথা পেয়ে যায় সে। তখন চুপকথাতে রূপকথাতে দিনজুড়বে মনজুড়বে তার।আর আমি তখন...
                                                                 -----------------

মূল্যবোধ

 জয়া গুহ(তিস্তা)



প্রথম পাতায়, তখন বয়স আট কিংবা নয়
ক্লাস ফাইভ, 
নতুন স্কুল কিছু বানান ভুল
তারপর কিছু পাতা ওলটাতেই,
কলেজের কথা, প্রথম প্রেমের দিকটায় ইঁদুর কেটেছে হুঁশিয়ারি দাঁতে, ডায়েরীটার মাঝ পেরিয়ে শেষের দিকটায় কাঁপা হাতের অক্ষর
"খোকা ফিরে আয়"
মায়ের  হারমোনিয়ামের তিনটে রিড ভাঙা
বেলো টানলে আওয়াজ কম, হাওয়া বেশী ধরণের
বাবার মাসের হিসাবী খাতা,
যত্নে গুছোনো পৈতের প্যাকেট,জলছাপ গড়ন
বাইরে থেকেই  গোলাকার সুতো ঝাপসা চোখে পড়ে
পিসিমনির ক্লাস এইটের রেজাল্ট,
থার্ড পজিশন পেয়েছিল,শুধু অঙ্কে একশোয়, একশো
ঋজুর আঁকা প্রথম ছবি,
হ্যালানো তালগাছ,পুকুরপাড়
খড়ের চালের মাটির ঘর,কাঁচা রাস্তা?
ও কখনো দেখেছে এইসব
নাকি সবটাই অভ্যাসের টান?
ভাঙা রথে সুভদ্রা রঙ চটা,
এছাড়াও ধূপদানি,মা লক্ষীর মূর্তি আটকানো কুলো
রামকৃষ্ণ চরিতামৃত ছেঁড়াখোঁড়া
ঋজুর প্রথম স্কুল-ইউনিফর্মের পাসপোর্ট সাইজ ছবি
বই খাতা...
বেঙ্গলী মিডিয়ামের ক্লাস টেন অবধি, কিছু কিছু নাম টিকে আছে
বাকি টুকু ইঁদুর চিনেছে
বাকি টুকু সময় ছিঁড়েছে
"এতকিছু! মাত্র একশো ছেচল্লিশ টাকায়" বলে দরদাম চুকিয়ে উঠে গেলেন মিসেস স্মৃতিলেখা বোস।
"পুরানো খাতা- বই-লোহা বিক্রি আছেএএএএ"
পড়ে থাকা স্মৃতির মত,
২৭/বি হো-চি-মিন সরণীর বোস ম্যানশন এর  বারান্দা জুড়ে কিছু ধুলো তখনও, যা বিক্রি হলনা...।
                                          ---------------


  ১৩ নম্বর

  অর্থিতা মণ্ডল

ওরা আসে।ওদের কোনো শরীর নেই।অন্ধকার ঘরের ভেতর শব্দেরা ভারী হচ্ছে।নিঃশ্বাসের ঠাণ্ডা স্পর্শ ।দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলে বালিশের ভাঁজে অনেক ঠিকানা।
ঠিকানায় নামের জায়গাটা শূন্য।
ও বারান্দার ইজিচেয়ারটায় বসে।আজ অমাবস্যা।এই চেয়ারটা মায়ের খুব পছন্দের।কয়েক বছর আগে বাইক দুর্ঘটনায় মা মারা যান।বাইকটা ও চালাচ্ছিল।
এই মুহূর্তে টের পায় একটা নরম হাতের স্পর্শ।প্রিয় নারীর ছোঁয়ায় তলপেটের নীচে শিরশিরানি।
"কতদিন পরে তুমি এভাবে আমায় জড়িয়ে ধরলে বলো তো!"
"জড়িয়ে ধরে থাকতেই তো চেয়েছিলাম।সেদিনও জড়িয়ে ধরেই ছিলাম কিন্তু!"সে হেসে ওঠে।
হঠাৎই হাসির দমকটা বদলে যাচ্ছে।বীভৎস আর্তনাদ।

দিনটা মেঘলা।ও বাইক চালাচ্ছে।হাই স্পীড।পিছনে সে।ওকে জড়িয়ে ধরে।ওর নিজেকে নায়ক মনে হচ্ছে।স্পীড বাড়ছিল।রাস্তা নয়,আকাশে ভাসছে।সে ভয় চিৎকার করে।
"আস্তে চালাও।এভাবে চালিও না।আমার ভয় করছে।মায়ের ব্যাপারটা ভুলে গেলে।"
কথা শেষ হয় না।বিকট আওয়াজ।যান্ত্রিক।দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ে।ও রাস্তার ধারে।সে রাস্তার ওপরে।ব্যস্ত রাস্তায় অন্য একটা গাড়ি 'সে'র ওপর দিয়ে চলে যায়।

"স্যার ১৩নম্বর পেশেন্ট আবার হ্যালুসিনেসন দেখছে।প্রচণ্ড ছটফট করছে।সামলানো যাচ্ছে না।"
"আপনি ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করুন।কুইক।"
'ও',১৩নম্বর পেশেন্ট মেন্টাল  অ্যাসাইলামে ঘুমিয়ে পড়ে।
                                                        --------------


রিয়ালিটি

বিশ্বজিৎ সাহু


সুভাষ ভারী ব্রিলিয়ান্ট ছেলে । জয়েন্টে পজিশন নিয়ে এখন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট।  পড়াশুনা নিয়ে ও যতটা সিরিয়াস , বাস্তব নিয়ে ততটাই উদাসীন । সব বিষয়ে কমেডি । ওই এক দোষ ছেলেটার । স্থান কাল পাত্র না দেখে রসিক হয়ে ওঠে । হয়তো ওর ম্যানারসটা বড্ড কম ।
কেয়ার বাড়িতে কালীপুজোর রাতে খুব চটে গেছিল বন্ধুরা । মুড়ির ঠোঙায় একটি মেয়ের ধর্ষনের খবর সুভাষের কাছে হয়ে উঠেছিল সে রাত জাগার কমন শৃঙ্গার টপিক । ওর বক্তব্য " ধর্ষণ করলে মেয়েদের অত চিৎকার করার কি আছে রে বাবা ! এনজয় কর না ! বেকার লাফালাফি করে হয় মরে যাব নতুবা মিডিয়া ফ্ল্যাশ করে নিজের কলঙ্ক নিজেই রটাস । তার থেকে একজন দুজন বা বহুজনকে নিয়ে এডভেঞ্চার কর । তোদের মেয়েদের দিয়ে না কিস্যু হবে না । উঃ ! আমার যদি এরকম সৌভাগ্য হত । অনেক মেয়ে একসঙ্গে কামুক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার ওপর ..."
এরকম বহুবার বু জায়গায় সুভাষ কথাটা বলেছে । ওর বান্ধবীরা প্রত্যেকবার বিরক্ত হয়ে বলতে মানা করেছে । কিন্তু সুভাষের ভারী মজা । এখানেও ধর্ষণের প্রসঙ্গ তুলে থামার নাম নেই । ড্রইংরুমে একসাথে বসে নেশা করছিল । কখন যে ঘোরে পড়ে বিড়বিড় করতে করতে একা চিলে ঘরের বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে খেয়াল নেই ।
সুভাষের কথাটা শেষ হল না । সত্যি সত্যি তিন বান্ধবী একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর । দরজায় খিল দিয়ে পশুর মতো নিংড়ে খেলো সারারাত । ঢাকের বাদ্যি আর মাইকের গানে কাকপক্ষীও টের পেল না যে চিলঘরের মধ্যে তিন মাকালীর নৃত্য চলছে ।
--- "এবার দেখ সুভাষ কেমন লাগে ... ভালো লাগছে " । বলে টিনা সাপের মতো ঠোঁট দুটোকে কামড়ে ধরল । রাকা বলল --"অনেকদিন ধরে তোর আলফাল কথা শুনে আসছি... এবার তুই বুঝবি" বলে নখ দিয়ে ক্রমশঃ তার বুকে। ওদিক থেকে কেয়া হিংস্র বাঘিনীর মতো সুভাষের যৌনাঙ্গ কামড়ে ধরতেই দারুন আর্তনাদে ওদের তিনজনের ঘুম ভেঙে গেল ।
স্বপ্ন নয় । সারারাত ধরে যা কিছু স্বপ্নে দেখেছে তারা , তার কনামাত্র মিথ্যে নয় । চোখের সামনে চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে চিলেকোঠাময় । দারুন ভয়ে চিৎকার করে ওঠে তিনজন । কেয়ার হাতের মুঠোয় তখনো সুভাষের ছিন্ন যৌনাঙ্গ । দাঁত মুখ রক্তাক্ত । সবার নখে বাসিরক্ত আর ছেঁড়া চামড়ার গন্ধ । খাটের পাশে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে সুভাষের ক্ষত বিক্ষত নিথর দেহ । হাত বাড়িয়ে নিজের রক্ত দিয়ে সে লিখে গেছে " আই এম সরি " !!!
                                                                        -----------------


স্বপ্নভঙ্গ

সন্তু মুখোপাধ্যায়


দীর্ঘদিন বাপের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি বিদিশা'র।
অসুস্থ শ্বশুর আর সংসারের চাপে বিশ্রাম
নেওয়ার ফুরসৎ পাইনি সে।
    কিন্তু বেশ কয়েকদিন হল মন ভাল নেই,
তাই ঈশানকে রাজী করিয়েছে বাপের বাড়ি
যাওয়ার জন্য।
বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে কি যেন
একটা দেখে তাকে এলোমেলো মনে হচ্ছে।বাপের বাড়িতে পৌঁছেও সেইভাবে কারও সাথে ভালভাবে
কথা বলছে না বিদিশা,যা দেখে ঈশানও ইতস্তত বোধ করছে!কিন্তু কি হল বিদিশার!
বিদিশা বন্ধুর বাড়ি যাবার নাম করে বাপের বাড়ি থেকে সোজা দোকানে গিয়ে উপস্থিত হল!
-দাদা,প্রসেন আজ দোকানে এসেছিল?
-প্রসেন বলতে চ্যাটার্জী'র ছেলের কথা বলছেন?
-হ্যাঁ দাদা।আমাকে ওর মোবাইল নম্বরটা দেবেন?
-ও তো মোবাইল ব্যবহার করে না!আপনার জন্য ওতো আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল,
আর আপনি ওর খোঁজ করছেন!
-আপনি আমাকে চেনেন?আমার মস্ত বড় ভুল হয়ে
গিয়েছিল দাদা!আমি এ জীবন চাইনি দাদা!আমিও ওকে খুব ভালোবাসতাম ওকে কিন্তু বাধ্য হয়েই...
-আপনি জানেন ও কথা বলতে পারে না আর!এমনকি কাউকে চিনতেও পারেন না!
-আমি তবুু একবার ওকে দেখতে চাই।
এইসব আমার জন্যই হয়েছে!
এই বলে বিদিশা প্রসেনের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
সব কিছু কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে!
বাড়ি প্রায় ভেঙে পড়েছে,বাড়ির পাশে জঞ্জালের স্তুপ।
কিন্তু বাড়িতে তালা লাগানো দেখে আর তার মাথা
কাজ করলো না!
-তারপর বিদিশাকে একজন অপরিচিত লোক
বললো এই বাড়িতে আর কেউ থাকেনা!
প্রসেনকে দেখতে পাবার শেষ আশাটুকু শেষ হয়ে গেলো বিদিশার!
                 -------------------

   ওরকম মনে হয়

     সঞ্চিতা দাস


একটু চোখের আড়াল হলেই ছন্দ হারিয়ে ফেলে অহেতুক কেঁদে ওঠে কাঁচের খাঁচায় বন্দি পাখিটি। নাম তার মৌপর্ণা। খুব মিষ্টি মুখখানা,হলদে গায়ের রঙ,চোখ দুটি ডাগর ডাগর, আগুনে লাল করা ঠোঁট, তাকালে চোখের পলক পড়বে না এমন বরফ নামা রূপসী।এই আধুনিক যুগের বউ মৌপর্ণা। স্বামী আছে, এক বছর সাত মাস তিন দিনের কণ্যা আছে, চার বছর পাঁচ মাস সাড়ে বারো দিনের পুত্র আছে, শাশুড়ি আছে, শ্বশুর আছে, তার দুটো বিনুনির চুল বেঁধে দেয়; কাপড় দড়িতে এঁটে দেয় এমন একজন ঘরোয়া কাজের মেয়ে আছে।নাম রূপসা, চোদ্দ পনেরো বছরের হবে। খুব ছোট থেকেই এখানে আছে, এক গ্রামের মেয়ে বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। একবার মৌপর্ণার শাশুড়ি সেই গ্রামের মন্দিরে পূজো দিতে গিয়েছিলেন সেখানের কালি ঠাকুর নাকি খুব জাগ্রত। পূজো দিয়ে বেরোনোর পথে এক শিশু এসে মায়ের প্রসাদ চাইল, বলল 'একটু  প্রসাদ দেবে গো আমায় খুব খিদে পেয়েছে; ওটা কি গো? এতবড় সন্দেশ, কখনও খাইনি দেবে একটু আমায়...?' মৌপর্ণার শ্বাশুড়ি খুব ইমোশনাল মানুষ, তখনই রূপসার পরিচয় জেনে ওর বাড়ি গিয়ে অনুমতি নিয়ে ওকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন, টুকটাক কাজ করে দেয় আর মৌপর্ণার যত্ন রাখে ওদের খুব ভাব, মৌপর্ণার শাশুড়ি দুজনকেই দুই মেয়ের মত করে আগলে রাখে। তবু মৌপর্ণার মাঝে মাঝেই মনে হয় এমন কোনও কি দেশ নেই যেখানে কর্তব্য নেই, নিয়ম নেই, সমাজ নেই, অভিযোগ নেই, প্রতিযোগিতায় দৌড় নেই, শুধু ইচ্ছেটা ইচ্ছেমতো হোক তার দাম আছে, তুমি তুমি আবহাওয়ার তৃপ্তি আছে,  চাপা চাপা রঙের খুশি আছে, আর চোখের কোনায় অনুভূতির জল আছে;যা গড়িয়ে ভক্তি আসা প্রিয়জনের ঘাড়ের শোল থেকে হৃদয় ছোঁবে! তখন কেউ বারণের সারণিতে থাকবে না, শুধু ইচ্ছে আর ইচ্ছের তুমি! এমনকী এও হতে পারে যে, আধো আধো ঘুম ভাঙা চোখের দরজা খুললেই তার ব্যক্তিত্ব আবেগ বাড়িয়ে আলস্য বোধের বায়না ধরবে! এমন কি হতে পারে না..কেন হয় না? এই তার প্রশ্ন ।
এরকমই আবার স্বপ্নকে বাস্তব করতে চায়, অথচ তার একটা বাস্তব আছে, ঘর আছে, সংসার আছে,  সংসারের এতজন সদস্য আছে কিন্তু তা সে চায় আবার চায়ও না। মনগড়া নয় বোধহয় এটাই সত্যি হওয়া সহজ নয় জেনেও তার পাওয়ার ইচ্ছেটা বেশি। তখন তার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলেছিলেন-যাহা পেতে চাই তাই পাইনা, যা চাইনা তাই পাই। সেটাই খুব সত্যি। কথাটা সঠিকভাবে মৌপর্ণার স্মরণে ছিল না। কিন্তু আসল মানে টা ঠিকই বুঝে মনে রেখেছিল।
নড়বড়ে জীবনের বেঞ্চিতে বসে একমুঠো হাসি সঞ্চয় করতে চায়, এই মেঘাচ্ছন্ন আনন্দ নাকি বেদনা এসব কাটিয়ে বেপরোয়া হতে চায়, যেখানের শহরের রাস্তার পাশে ইঁট চাপা ঘাসে গুনগুনিয়ে গান ধরে কখনও আলতা পরবে পায়ে, কখনও এগলি ওগলি ঘুরে ঘুরে সবুজ মটর খাবে, কখনও কাজল কালো চোখে বই পড়বে আর বৃষ্টিতে ভিজবে। আবার কখনও উদাসী চোখ খোলা চুল, আঁচল মাটিতে এলোমেলো এমন জ্যোৎস্নায় নদীর ঘাটের ধারের পাটাতনে বসে ঘুমিয়ে পড়বে, কখনও রুটি রুজির জন্য চালভাজা চিড়েভাজা বাদামভাজা নিয়ে বিক্রির জন্য যাবে, কখনও পাহাড়ের দেওয়াল;তাদের সবুজের হৃদস্পন্দন খুঁজে নিজের জীবনের  আস্বাদ জীবনের  স্পন্দন আত্মহারার সংগীত ফিরে পাবে... এবং... কিন্তু  এমন বা ওরকম মনেই হয় বাস্তবে এতটা মুক্তি নেই থাকলেও তা কঠিন...ভাবতেই  হল ওরকম মনে হয়! 
                                                                          -----------------

ফেরা
সন্দীপ খাটুয়া


সবে সকাল। ঘন কুয়াশায় মাখামাখি গাছপালা রাস্তাঘাট।ভোলা তার সিদ্ধান্তে অনড়। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ঘরে ছয় মাসের একটা মেয়ে,বউ, মা,ছোট ভাই'কে নিয়ে সংসার তার। ভাই এখন ইন্টারমিডিয়েট। পড়াশুনা থেকে সংসারের যাবতীয় তেল নুনের খরচ;সব দায়িত্ব তার নিজের ঘাড়ে। সময় খুব অল্প। তাকে দুপুরের আগেই ফিরতে হবে বাড়ি। আজ ভোলার মেয়ের মুখে ভাত। ইচ্ছে ছিল সকল আত্মীয়-সজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে এক জমজমাট অনুষ্ঠান করবে, তা আর হল কই। কাজ অফিস আর পাঁচটা ঝামেলায় খেলো জীবনের কর্মসূচী।
একটা কন্ট্রাক্টরের কাছে ভোলা সুপারভাইজারের কাজ করে। পুরো নাম সুদীপ সোনার। শান্ত স্বভাবের জন্য লোকে ভোলা বলে ডাকে। কাজ থেকে মেস- সমস্তাই তার দায়িত্বে। গরিব বাড়ির ছেলে হওয়ায় এবং বাবা পরলোক গমনে ইতি পড়ে পড়াশুনায়। সাইটে কাজ নিয়ে একটা রাজনীতিগত ব্যাপার ঘটেছে। কিছু কর্মচারী ফ্রিতে বাহবা লুটছে। আর সমস্যা হলেই ভোলার কীর্তি। ভোলার এইসব ভাল লাগে না,এসব পিনমারা রাজনীতি থেকে সে দূরেই থাকে। কিন্তু কোম্পানির কাছে ক্রমেই অজান্তেই সে বিষাক্ত হয়ে উঠছিল। কদিনের ছুটি চেয়েছিল, সামন্তবাবু তা সরাসরি না করে দেয়। ভেবেছিল একটু কাকুতি মিনতি ভরে চাইলে হয়তো কাজ হাসিল হতে পারে। কিন্তু তাতেও বাধসাধল। বরং যত অসংযত, অসংলগ্ন ব্লেম জুটলো কপালে। সাফাই দেওয়ারও সুযোগ বা প্রমাণ দিলেও কানে নিলেন না। মেজবাবু নাকি ছুটি দিতে পারবেন না, জানিয়ে দিলেন সরাসরি সামন্তবাবু। আসলে কোম্পানী লো লেভেল ইমপ্লোইদের কথা সরাসরি গ্রাহ্য করে না। প্রোজেক্ট ইন চার্জ সুবিমল বাবুর কাছে একবার আবদার করবে ভাবল। সুবিমল বাবু কোম্পানীর অনেক পুরানো লোক। কিন্তু উনি এমনিতেই ভোলাকে পছন্দ করেন না। যখন তখন হেন তেন প্রকারে অপদস্ত করতে পারলেই খুশি হন। ভোলা অনেকবার সামন্তবাবুর কাছে রিপোর্ট করলেও কোনো সুফল পায়নি,উল্টে জুটেছে আরও বেশি বেশি দোষারোপ আর কোম্পানির ঘরে ভোলার  অকর্মদক্ষতার রিপোর্ট। ভেবেছিল সরাসরি মেজবাবুর কাছে রিপোর্ট করবে সুবিমল সেনের নামে,কিন্তু মেজবাবু বছরে আসেন এক-আধবার সাইটে।
অনেক ফোন,আবদার করেও ছুটি পায়নি। শেষমেশ ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সুবিমল চাইত ভোলা জব টা ছেড়ে পালাক। কিন্তু ইনকাম ছাড়া সংসার,ভাইয়ের পড়াশুনা,মায়ের ওষুধ চলবে কিভাবে। সব ঝামেলা সয়েও পড়েছিল সে। কদিন ধরেই মনের মধ্যে অনেক জল্পনা কল্পনা চলছিল ভোলার। সারাটা রাত ঘুম নেই তার।শুধু বাড়ি ফিরতে মন চাইছে।  ছোট মেয়েটার মায়ামাখা মুখটা মনে পড়ছে। আজ আবার মেয়েটার মুখে ভাত। ওদিকে যতটা সম্ভব আয়োজন করেছে বউ। রাতে অনেকবার ফোন হয়েছে। স্থিতি নেই মনে।
অনেকটা পথ। ট্রেনে ভগবানপুর। তারপর বাস। আশারিয়াপুর গ্রাম। গঙ্গারতীরে একটা ছোট গ্রাম। আজ দুপুরের আগে ফিরতেই হবে তাকে। বাড়িতে হয়তো তোড়জোড় চলছে, হয়তো সবাই আনন্দে তার পথ চেয়ে বসে আছে। আনন্দের সাথে সাথে  আশঙ্কাও রয়েছে, তবে সেটা চাকরি যাওয়ার না, সেটা উপার্জনের।
কুয়াশায় রাস্তাঘাট অন্ধকার। শুধু শিশির বিন্দু পড়ার শব্দ। কিছুটা হেঁটে বাস স্টপ। কুয়াশার মাফলার সয়টার সেঁতসেঁতে, ঠাণ্ডাও লাগছে। অন্ধকার কুয়াশা ভেদ করে বাসের হর্ন। লাইট টাও ঠিক স্পষ্ট না। রবিমামার এখনও সময় হয়নি ওঠার। মেয়েটার মুখ'টা খুব মনে পড়ছে ভোলার।  মাথায় শুধু এখন একটাই চিন্তা,তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। ফিরতেই হবে।
                    ----------------

ভাসানের পর ৫

দুঃখানন্দ মণ্ডল


: বাবু গো আমি অন্ধ নয়,আমার দৃষ্টি শক্তি আছে কিন্তু ক্ষমতাশক্তি হারিয়ে গেছে,তাই ভিক্ষাবৃত্তির পথে পা বাড়িয়েছি।বাবু গো দু'টা টাকা সাহায্য করে যান।
জীবন।
পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে খড়্গপুর পর্যন্ত  তার ভিক্ষা করার পথ।
: কিগো আজ বেরোবে না! এখনো শুয়ে আচ্ছো?
কদম।
জীবনের সহধর্মীনি।বাসন মাজে অন্যের বাড়িতে।
: যাবো,আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে।একটু আগুন জ্বাল তো রোদ পড়া উঠানে।গা হাত পা সেঁকি।
: তোমার না বুড়ো বয়সে যত সব! দাঁড়াও দেখচ্ছি।
: বুঝলি কদম আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাবা শীতের কালে খড় দিয়ে আগুন জ্বালতো আর আমরা সেই তাপ নিতাম।তারপর যত রোদ বাড়তো ততই আগুনে তাপ মজে আসতো।আমি, বাবা আর মা তিন জনে ঐ নিভে যাওয়া আগুনের ছাঁইয়ের কাছে পেট ভরে রাতের জল দেওয়া পান্তা ভাত খেতাম। আজ বেশ মনে পড়ে।
কদমের হাতে জ্বলে উঠচ্ছে আগুন।আগুনের পরশ স্পর্শ করছে কদম আর জীবনের শরীর।
: কদম তো মনে আছে,যে শীতে বাবু হলো? আমি কেমন বড় মাটির মালসায় করে আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরম করতাম।আর বাবু চোখে ভেসে উঠত সেই আগুনে শিখা।আর তুই বলতি বেশ গণগণে আগুনটা হয়েছে, খুব গরম হচ্ছে ঘরটা।
কদমের চোখে জল।
আসলে স্মৃতি এমন একটি সম্পর্ক; যা দুঃখ আর আনন্দ দু'জনের সাথে থাকে।
: কিরে কদম! তুই কাঁদছিস?
: না কিছু না!
জীবন  বুঝে; কদমের জীবন যন্ত্রণার কথা।বুঝে একজন মায়ের কোল শূণ্য হওয়া।
আগুনটা মজে আসচ্ছে।রোদের হাল্কা তাপ পিটে লাগছে।
জীবন রওনা দিল গতির দিকে।
আজ বেশ ভিড় হয়েছে ট্রেনের কামরাগুলোতে, ভিতরে যাওয়ার একটু ফাঁক নেই। তবু ঢুকতে তো হবেই।জীবনের গলায়  প্রতিদিনের ভিক্ষা করার শব্দ শুনতে পেল যাত্রীরা।
: বাবু গো আমি অন্ধ নয়...
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটা ডাণ্ডা ভাঙা দড়ি বাঁধা জীবনের চশমাটা পড়ে গেল।সে বসে পড়লো আর খুঁজতে লাগল। একজন যুবক হাতে নিয়ে জীবনের হাতে দিল।কিন্তু ততক্ষণে ডানদিকের কাঁচটা ফেটে গেছে।
জীবনের বুকটা ধড়াশ করে উঠল।চোখটা ছলছলিয়ে উঠচ্ছে।
ট্রেনটা ছুটছে।
: দাদু তোমার বাড়ি কোথায়? কে কে আছে বাড়িতে?
তখন জীবনের চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে...
: দাদু এটা রাখো।বিকেলবেলায় আর বেরোবার দরকার নেই।একটা চশমা অর্ডার দিয়ে দিও।
: না না বাবু আমি নিবো না।এতোগুলো টাকা!
: ধরো তোমার ছেলে তোমাকে দিচ্ছে।
: না বাবু ছেলের নাম করে আমাকে দিও না।আমি নিতে পারবো না!
: কেন?
: এর উত্তর নেই।
জীবন রেগে হনহনিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল।পিছু নিলো যুবকটি।
ট্রেনটা প্লাটফর্ম স্পর্শ করলো।মানুষের ভিড় নেমে যাচ্ছে।তাদের সাথে জীবন আর ঐ যুবক।
: দাদু রেখে দাও।বিকেলে অর্ডার দিয়ে দিও।আমি তোমার ছেলে নয়;আমি একজন মানুষ।একজন মানুষ আর একজন মানুষের দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছে।
: নাও।
: তুমি কে বাবু?
: আমি একজন পথযাত্রী।
আবার একটি ট্রেন প্লাটফর্ম ছুঁয়েছে। যুবকটি উঠে পড়ল।
হুইসেল বাজিয়ে গন্তব্যস্থানের দিকে দৌড় শুরু করলো ট্রেনটি।
প্লাটফর্ম ক্রমশঃ ফাঁকা হচ্ছে।জীবন দাঁড়িয়ে আছে।আর চোখে ভেসে উঠছে নিজের বাবুর ছবি।
বাবু এখন অনেক বড় আফিসে চাকরী করে...
                        -----------------

2 comments:

  1. বাহ! বেশ গল্প গুলো।

    ReplyDelete
  2. একটা অভাববোধের বিপন্নতা ছাড়া ছোটগল্প ঠিক জমে না।কবিগুরু সেই কবে বলেছেন," যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাইনা।"(উৎসর্গ ৭)।এবারের কোরাসে প্রকাশিত সব গল্পগুলিই জমজমাট। সবচে ভাল্লাগলো মোহাম্মদ জসিমের লেখা।রিয়া চক্রবর্তী র বর্ণনা,জয়া গুহর গল্প বলার স্টাইল,দুঃখানন্দ মণ্ডল আর সন্দীপ খাটুয়ার কাহিনী মন ছুঁয়ে গেল...

    ReplyDelete

তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮০

  তৃষ্ণা বসাক এর কবিতা ১. মহানির্বাণ   চুন্দ, চুন্দ, এখনি এই শূকর মাংস মাটির গভীরে পুঁতে ফেলো, পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে এই মাংস পরিপাক করতে প...