Sunday, 25 August 2024

প্রতিবাদের ভাষা // ই-কোরাস ১৯২

 



১.

অসুখ ১

তৃষ্ণা বসাক 


অনেক বছর পর আবার একটা ঠান্ডা ঘর,

বিটাডিনে ধোয়া লম্বা করিডর,

লিফট থমকে যায় সেখানে এসে, একদম শেষ প্রান্তে

কড়ির বাটি ভর্তি  ডাল ভাত, ওপরে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল

আমার দিকে এগিয়ে আসে লম্বা লম্বা ছায়া ফেলে,

ভাতের প্রতিটি দানার ছায়া পড়ে আমার শরীরে,

শ্রোণিদেশে সহসা সুঁই ফুঁড়ে

চলচ্ছক্তিহীন করে দেওয়া হয়…

 

এ ঘরে জানলা আছে, জানলায় বসার জন্যে আমি  নেই,

জানলা খোলাও হয় না অনেকদিন,

শুধু ঠান্ডা মেশিনের মিস্টি ঘুর ঘুর আওয়াজ

আমাকে জাগিয়ে রাখে,

আচ্ছন্ন যেমন জাগে, সেরকম উসুম কুসুম জাগরণে

আমি ভাবি আজ তো কেউ আসবে,

এই আরোগ্যনিকেতন তো শহরের বাইরে নয়,

ফুটপাথে এত ফুলের পসরা,

আজ তো কেউ আসবে…

 

ঠিক তখনি কি তাকে ওরা গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল?

ভোরের ব্রাহ্ম মুহূর্তে,

এত মিলি সিমেন-

ভিকি ডোনার কি দিতে পেরেছে এক জীবনে?

 ফার্টিলিটি ক্লিনিকের বাইরে ভিড় করা এই শহরের পুরুষেরা-

এত বীর্য তোমরা কোথা থেকে পেলে-

ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়ি,

আবার জাগি,

আমার এখন কোন রাত্রি নেই, আমার এখন কোন দিন নেই।



২.

কন্ডোম কবিকে লেখা 

বিশ্বজিৎ বাউনা


ঝলসে উঠেছে চোখ? লিখে দিলে সেই যোনিপথ 

গলি রাস্তার ফালি কেটে উগ্র লিঙ্গেরই মহিমা!

মাংসের কাদা ভেঙে কিভাবে ছোটে কামেরই রথ...

এঁকে দিলে সর্বগ্রাসী নারী-চেরা? যার নেই সীমা!


তবে কি যোনি পূজ্য নয় আর? ধর্ষণে তার পাঠ

তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে নেবো লেখা জুড়ে?

জানি প্লুত সেই বোধের অক্ষরে ভরে গেছে মাঠ,

কালান্তক পাখি মরে গেছে, শিকারী প্রকোপে পুড়ে।


আজ দিকে দিকে সতেজ সব মাংসের কারবারী।

ক্ষমতাগ্রাসী বলদের হুঙ্কারে থিতু মেঘ জল...

লিঙ্গের সন্ত্রাস ছিঁড়ে দিতে পথে নেমে এসো নারী,

তীব্র চন্ডার মতো আজ তুমি নিজে হও প্রবল।


কন্ডোম কবির মতো চেপে ধরে আছে সময়েরা।

বুঝিয়ে দাও-হে নারী, তুমি শুধু নও যোনি-চেরা।



৩.

দশভূজা ও তিন নম্বর চোখ

মৌপর্ণা মুখোপাধ্যায়

 

আরও আটটা হাত

তুমি ফেলে এসেছ উৎসস্থলে 

মনে রেখো 

অসুরবেষ্টিত চারদিকে 

নিরাপত্তা শব্দটিতে ধুলো জমে গেছে;

দশভূজা হতে হবে তোমাকে।

দুই হাত দিয়ে 

তুমি কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলো পদ্মফুল

স্টেথোস্কোপে শুনে নিতে পারো স্পন্দনকথা

পরম মমতায় কোলে তুলে নাও সদ্যজাতকে

স্নেহমাখা স্পর্শে মুমূর্ষু সন্ধান পায় ভোরের আলোর।

  

 ছত্রিশ ঘন্টা কর্তব্যের পর যখন

ক্লান্তি এসে ছুঁয়েছিল দুই চোখের পাতা

তখনই জাগ্রত হবার প্রয়োজন ছিল 

তিন নম্বর চোখ ও বাকি আটটা হাতের।

নেকড়ে হায়নাদের জন্য শুধু দুটি হাত যথেষ্ট নয়।

সভ্যতা ফিরে গেছে প্রস্তরযুগে;

ত্রিশূল ,খড়গ ও অন্যান্য হাতিয়ার নিয়ে

এবার সময় হয়েছে দশভূজা হবার।



৪.

আগুন খাতার পৃষ্ঠা  থেকে -৩

শ্রীজিৎ জানা


তোমার স্বর 

আমার স্বর

বলতে চায়

আর জি কর

তোমার ঘর

আমার ঘর

রুখতে চায়

আর জি কর

আর জি কর


গাছ পাথার

মাঠ পাহাড়

চায় বিচার

গর্জে স্বর

আর জি কর 

আর জি কর।


মা বাবার

কোল খালি

বুক খালি

দাও সাড়া

গ্রাম শহর

আর জি কর।


শ্লোগানে

ময়দানে

ক্যানভাসে

রাজপথে

উঠুক ঝড়

আর জি কর।


আজ যদি

চুপ থাকো

মুখ ফেরাও

অন্ধকার!

আজ যদি

চোখ রাঙায়

ভয় দেখায়

ছিছিক্কার!


পা বাড়াও

পা বাড়াও

হও সরব

চাই বিচার

ধর্ষিতার

জাগতে চাই

গ্রাম শহর

রাত প্রহর

আর জি কর

আর জি কর!



৫.

দেবীপক্ষ ২

দুঃখানন্দ মণ্ডল 


তুমি দেবী, তোমার পাশে বসি।

তুমি নারী, তোমাকে শ্রদ্ধা করি তোমার অজানতে। 


তুমি প্রশ্ন করেছিলে ঐশ্বরিক শক্তি নিয়ে,

উত্তরে বলেছিলাম তুমি নারী, তুমি দেবী।


প্রদীপ জ্বলছে। উচ্চারিত হচ্ছে মন্ত্র 

তোমার মন্ত্র। বিশ্লেষণের পর রয়ে যায় অনুচ্ছেদ। 


তুমি নারী। ক্ষমতা তোমার হাতের নাগালে;

শ্রদ্ধাশীলতা। তুমি এখনো আটপৌরেই থেকে গেছো। 


তুমি নারী : তুমি দেবী

আসলে তোমারই পুজো হয় দেবী রূপে… 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Saturday, 17 August 2024

কবির মৃত্যু নেই; মানস কুমার চিনি // ই-কোরাস ১৯১

  



১.

আশিস মিশ্র 


ঘুম ভাঙলে ইদানিং বিছানায় কিছুটা সময় বসে থাকি। বুকের ভেতরে একটু খুটখাট হলেই মনে হয়, তবে কী.. 

পুনরায় দৌড় শুরু হয়। হঠাৎ কমলের টেলিফোন। মানস চিনি নেই! খবরটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাইনি, কেননা মানসের পথেই তো যেতে হবে একদিন। তারপর ফেসবুকে মানসের ছবি দেখতে দেখতে মনে হলো, ওর তো চলে যাওয়ার সময় হয়নি এখন! 

ছয়- এর দশকে জন্ম নেওয়া আমাদের অনেক কবি - সম্পাদক - শিল্পী - সাংবাদিক বন্ধু রয়েছে। কেউ কেউ শূন্যে মিলিয়ে গেছে! কেউ কেউ অসাধারণ কিছু কাজ করছেন, কেউ কেউ ভালো লিখেও মৃত্যুর পর আর এজগতে বেঁচে নেই! মানসকেও একদিন সবাই ভুলে যাবো, দু' চারটে স্মরণসভার পর। মৃত্যুর আগে ও পরে কবিজীবনের এই ট্র্যাজেডি আমাদের অনেকের জন্য শিরোধার্য হয়ে গেছে। 


৮-এর দশকের শেষে ও ৯-এর দশকে মানস সহ আমাদের কবিবন্ধুদের বেশ দাপট ছিলো। হঠাৎ হঠাৎ মেচেদার রেল কোয়ার্টারে মানসের কাছে চলে যেতাম। চায়ের আড্ডায় লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি নিয়ে কথা হতো। তখন মানস বিভিন্ন সংবাদপত্রে পত্রলেখক হিসেবে বেশ পরিচিত। তারপর তার কবিতার ভুবন জয়। দেখতে দেখতে ১ ফর্মা ২ ফর্মার কবিতার বই প্রকাশিত হতে থাকল। মেচেদা ছেড়ে মানস চলে গেল খড়গপুরে রেল কোয়ার্টারে। ঠিকানা না দেখে দূর থেকে বলে দিতাম, এটি মানসের চিঠি। তার সঙ্গে আমার কিছু  চিঠির আদান- প্রদান হয়েছে। তার

দু' চারটে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে। 


মানস তার মনের মতো একটি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে তোলে। অখণ্ড মেদিনীপুর জেলায় তখন সম্ভবত ওর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি প্রথম( এই তথ্য ভুল হলে বলবেন)। সন্দীপ দত্ত-র প্রেরণায় এই লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে কলকাতার বাইরে। মানস যখন যেখানে থেকেছে তার বন্ধুবৃত্তের অভাব হয়নি। কত নাম বলবো? আর কত কবিসভার কথা বলবো? অনেক সভাতেই মানস সহ আমরা অনেকেই থেকেছি। মনে পড়ে একবারাই ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম (বাজকুলের অদূরে)। আর খড়গপুরে ওর কোয়ার্টারে একবার। তখন ওর সাংসারিক টানাপোড়েন শুরু হয়নি। মানস বলে ডাক দিতেই সে দরজায় এসে দাঁড়ালো। এক গাল হেসে ভেতরে নিয়ে গেলো। ভাবলাম এবার বুঝি ও বাড়িতে তৈরি চা- টা খাওয়াবে। কিন্তু না,  মানস আমাদের দুই বন্ধুকে নিয়ে স্টেশনের কাছে এসে চা খাওয়ালো। বেশ কিছু সময় কথা হলো। তখন ওকে বেশ আফসোস করতে দেখেছি কবিতা নিয়ে। শুনলাম, পরে পরে মানসের জীবনে ছন্দপতন। ওর সব বইপত্র সে দান করে দিয়েছে, এবং কলকাতায় চলে গেছে। রেলের চাকরিতেও নেই। 


তার মধ্যেও ওকে বেশ উদভ্রান্ত অবস্থায় দু' একটি জায়গায় দেখেছি। হলদিয়াতে ডেকেছি। তবে ওর শরীরের অসুস্থতার জন্য হলদিয়ার কবিসম্মেলনে প্রতিবছর ডাকতে পারিনি। কেননা ও বেশি সময় আড্ডা দিতে পারতো না। বিশ্রাম নিতে হতো ওকে। একটা সময় এই কবিসম্মেলনে না - ডাকার জন্য ওর রাগ বা অভিমান হয়েছিল। যে কারণে ও একটি মুখবন্ধ খাম পাঠিয়ে দিত। তাতে ওর রাগ ও অভিমানের বিষয় ধরা পড়তো। সেই সব চিঠির উত্তর দিতাম না। কিন্তু কলকাতায় মুখোমুখি হলে চা খেয়েছি, আবার কখনো পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা হতো। ওর মৃত্যুর আগের কয়েক বছর ওর সঙ্গে তেমন অটুট বন্ধুত্ব ছিলো না। এর কোনো বিশেষ কারণ ব্যাখ্যা করা মুশকিল। 


তবুও মানস কলকাতায় থাকতে থাকতে তার লেখালেখির জগতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এসব দূর থেকে বুঝতাম। বড়ো কোনো পত্রিকার শারদ সংখ্যায় তার কবিতা ছাপা হচ্ছে, বড়ো প্রকাশনা থেকে তার বই বেরচ্ছে --তার খ্যাতিতে আমরা অনেকেই আনন্দ পাচ্ছিলাম। কিন্তু মানস ভেতরে ভেতরে একেবারে যে একা হয়ে গেছিল, সেই 'একা মানসকে' আমি ও আমরা অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছি! 

তার নিজের লেখালেখি নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি  বই নিয়েও এমন একজন মানুষকে ফেসবুকে বিরুপ মন্তব্য করতেও দেখেছি। সে-সব নিয়ে মানসের কিছু যায়- আসেনি। কেননা, যে কোনো মেদিনীসন্তানের কবিতার প্রবল পরিক্রমা, শহুরে কোনো কোনো বাবুকবির কাছে যে মান্যতা পাবে না --এটা জানা হয়ে গেছে। মানস মরে গিয়েও প্রমাণ করে গেলো, কবিতার আঙ্গিক, ভাষা ও বিষয়বস্তু সে তার নিজের মতো করে লিখে গেছে। হয়তো প্রবল প্রতিভাবান সে নয়, কিন্তু কবিতাপ্রাণ বটেই। এটাই 'চেনা মানস' ; আর 'অচেনা মানস' - কে সে তার নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখত।


২.

সুকান্ত সিংহ 


এক বিক্ষুব্ধ সময়ে কবি মানসকুমার চিনি চলে গেলেন। অনেক নয়, তবু তাঁর সাথে দেখা হওয়ার কিছু স্মৃতি রয়ে গেল আমার কাছে। একবার বিদ্যাসাগরের জন্মগ্রাম বীরসিংহে একটি অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা। কথার মাঝে তিনি আমার মতো অবার্চীনকে দিলেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই 'একক সঙ্গীত সন্ধ্যায়'। চমৎকার হাতের লেখায় পরম যত্নে সে বইয়ের পাতায় লিখলেন আমার নাম। তার পর মৃদু হেসে বললেন, পোড়ো সময় করে। আরও পরে, পড়ে আসা এক শীতের বিকেলে আকস্মিক দেখা নয়া গ্রামের পটের মেলায়। দেখতে পেয়েই কী খুশি! সেদিন ব্যাগের থেকে একটি চিঠি বার করে তার খামের গায়ে আমার নাম লিখে বললেন, দেখো যদি যেতে পারো। চিঠি খুলে দেখি শান্তিনিকেতনে একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণপত্র। 


শেষবার তাঁর সাথে দেখা হল কলেজ স্ট্রিটে ধ্যানবিন্দুতে। একই রকম হাসি মুখ। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপর একটি ছোট্ট পুস্তিকা, আর, ছোট্ট আয়তনের একটি বই 'রেশমাকে লেখা কবিতা' দিলেন হাতে। 


লেখালেখির পরিসরে কারো সাথেই খুব নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতে পারিনি কখনো। অথচ কতজনের লেখা পড়েছি। অন্যকে পড়তে বলেছি। মানসদার সাথেও ঠিক এটাই ঘটেছে। উড়ো উড়ো শুনেছি খড়্গপুর ছেড়ে তাঁর চলে যাওয়ার কথা, চাকরি ছাড়ার কথা, অসুস্থতার কথা। ওই পর্যন্তই। অথচ আজ যখন জানলুম তিনি নেই, চোখের সামনে ভেসে উঠল ঝাঁকড়া চুলের একজন মানুষ, কাঁধে ব্যাগ, সেখান থেকে একটা চিঠি বার করে খামের উপর আমার নাম লিখে দিচ্ছেন পটুয়াপাড়ায় দাঁড়িয়ে, যেতে বলছেন লালমাটির দেশে!


সম্পর্ক নিয়ে এত উদাসীন আমি যে, আমার তর্পণ বুঝি এ জীবনে আর ফুরোবে না!



৩.

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


প্রচুর চিঠি লেখার অভ্যাস ছিল মানসদার। হাতের লেখা দেখলেই দূর থেকে চিনে ফেলতাম তাঁর চিঠি। এতই মৌলিক তাঁর হস্তাক্ষর। সেইসব চিঠিতে ভালোবাসা যেমন থাকত, বকুনিও থাকত প্রচুর। স্নেহের সাথে মিশে থাকত শাসনের আর্দ্রতা। তখন কলেজে পড়ি। বাবার কাছে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চিঠি ও কবিতা আসত তাঁর। সাথে মোনালিসা পত্রিকা। খড়্গপুরের ঠিকানা থেকে প্রকাশিত হত এই কাগজ। দেখতাম। পড়তাম। মানসকুমার চিনি নামটি তখন থেকেই পরিচিত। প্রচুর লিখতে পারতেন মানসদা। একটা সময় ছিল যখন পত্রিকার পাতা ওল্টালেই মানসকুমার চিনি নামটি যেকোন পাঠকের নজরে আসত। বাংলা কবিতায় একটি নিজস্ব স্বর সংযোজন করেছিলেন তিনি। পড়লেই বোঝা যেত এ কবিতা সম্পূর্ণ অন্য ভূবনের।  নোনাবালি তাঁর প্রথম কবিতার বই।কী অসামান্য সব কবিতা। কবি বলতে আমরা যা বুঝি মানসদা আনখশির সেরকমই একজন কবি। তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন। কবিতার কাছে নিবেদন করেছিলেন নিজেকে। কবিতাই হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘরবাড়ি, তাঁর সংসার ও আত্মীয়স্বজন।  কবিতায় ভোরের আকাশ চেয়েছিলেন তিনি। যেখানে কবিতা হয়ে উঠবে অনেকটা ছবির মতো। সান্ত্বনার সুবাতাসের মতো। দারুণ দহন দিনে যা বাস্তবের স্থিত ভূমিতে  ছুঁয়ে থাকবে আমাদের হাত।


কবিতা লিখতে লিখতেই মানসদাকে চেনা প্রথমে কবিতার ভেতর। তারপর একদিন হঠাত দেখা হয়ে হলদিয়ায় বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবে। সালটা ২০১২ এরকম হবে। বললেন – চলো টিফিন খেতে খেতে একটু গল্প করি। গল্প তো আর শেষ হওয়ার নয়। স্মৃতির পাতা উজাড় করে দিলেন। বললেন তোমার সাথে প্রথম পরিচয়, কিন্তু মনে হচ্ছে কি যে এর আগে দেখা হয়নি? আমি বললাম – না তো। আপনি তো সেই কবে থেকে আমার চেনা, আজ প্রথম দেখা হচ্ছে । বই দিলাম আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। পড়ে বলেছিলেন- আরো লেখো, এখনই তোমার কবিতা নিয়ে কিছু বলব না। দ্বিতীয় বই হাইফেন বসানো বারান্দা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন। ফোনে বলেছিলেন- আমি সাধারণত কারোও বই নিয়ে কিছু বলি না, কিন্তু তোমার বইটি নিয়ে বলতে ভালো লাগল বলে লিখলাম। তবে কবিতাকে এত নিরেট করে দিচ্ছো কেন? একটা প্রবেশপথ তো রাখতে হবে নইলে পাঠক কবিতার অভ্যন্তরে ঢুকবে কী করে?  কবিতা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে তাঁর সাথে। সব কথা মেনে নিতে পারিনি কিন্তু শ্রদ্ধা জানিয়েছি তাঁর ভাবনাকে।  খুব সম্ভবত অন্যমন বলে একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন ততদিনে।


খড়্গপুর রেল কলোনিতে বই ও পত্র পত্রিকার সংগ্রহশালা করেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন-  কবিতা বাগান। প্রচুর পড়াশোনা করতেন মানসদা। বই কিনতেন। দুষ্প্রাপ্য সব বই। একবার বইমেলার ঘটনা, সালটা মনে নেই। দু ব্যাগ বই নিয়ে মানসদা হিমসিম খাচ্ছেন। বইতে পারছেন না। একবার কাঁধে ওঠাচ্ছেন, একবার নামাচ্ছেন।  বললাম- এত বই  নিয়ে যাবেন কী করে?  বললেন- সেটাই তো সমস্যা। লোভে লোভে কিনে ফেললাম, পকেটে যা পয়সা ছিল সব প্রায় শেষ। বইমেলায় এলে লোভটা সামলাতে পারি না। না পড়লে কি বাঁচা যায়? আজ বুঝতে পারি, কত গভীর উপলব্ধির কথা তিনি বলেছিলেন। তাঁর প্রচ্ছন্ন ছায়ার নিচে কত মুহূর্ত কেটে গেছে। মানুষটিকে দেখেছি একজন অতীব সুভদ্র মানুষ হিসেবে। নিজের বই প্রকাশ করলে কী অবলীলায় সবাইকে বিলি করে দিতেন অথচ কেউ বই দিলে বলতেন- এই নাও, এটা রাখো বই ছাপাতে খরচা হয় আমি জানি। কী অপরিসীম ভালোবাসা ছিল তরুণ কবিদের জন্য। বাংলা সাহিত্যে এমন কোন কবি নেই যার বাড়িতে মানসদার দশ খানা চিঠি নেই। মৃদু ও মর্মভেদী কবিতা লিখতেন- 

“চিবুকের ছুঁয়ে থাকা

চোখের কোণে জমে ওঠা জল

সেই অবাক নিয়তি

নিজের শরীর ও মন চেনে।

যেন মায়াসৌন্দর্যের রহস্য

কামনার তৃতীয় নয়ন।”

তিনি বিশ্বাস করতেন সততা ও ভালোবাসাই একজন কবিকে বড় করে তোলে।


“অনেক কাজ বাকি থেকে গেল

প্রেমিকা

তুমি জানলে না

জীবন পাথরের মতো ভারি

তবু যে শাসক কবিতাকে দেশদ্রোহী বলে

তার জন্য ঘৃণা উপহার দিলাম।”


কিছুই শেষ হয় না মানসদা। শব্দের ঐশ্বর্যে বাঁধা থাকে জীবন। এ কি ফুরোবার? কবিতালোকে থাকতেই তো চেয়েছেন চিরকাল। থাকুন। চির আনন্দে থাকুন।



৪.

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায় 


খবরটা দেখার পর মোবাইল সহ হাতটা কেঁপে গেল। মানস দা নেই!! শেষ ২-৩ বছর প্রায়শই ফোন করতেন। কবিতা নিয়ে কথা হতো। বিশেষত আমাদের জেলার তরুণরা কে কেমন লিখছে খুঁটিয়ে খবর নিতেন। আমি যতদূর সম্ভব জানাতাম। অসুস্থতার কথা বলতেন। বড্ড বেশি মৃত্যু চিন্তায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি বারংবার সাহস দিতাম। বলতাম ' চিন্তা করবেন না। আমরা আছি তো। মেদিনীপুর থেকে কলকাতা কী এমন দূরত্ব৷ কোনো অসুবিধায় জানাবেন। দ্রুত হাজির হয়ে যাবো। মনে জোর রাখুন। আমরা সবসময় আছি।' অথচ থাকতেই পারলাম না। 


শেষ দেখা হলো কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। কত কথা হলো। শেষ ফোন সম্ভবত মাসখানেক আগে। সেদিনও তরুণদের লেখালিখির খবর নিলেন। 


আমার লেখালিখির প্রথম জীবনে মানস কুমার চিনি নামক প্রতিষ্ঠিত এবং নামী কবিকে আমি দূর থেকে সম্ভ্রমের সাথে দেখতাম। কালক্রমে তাঁর সাথেই গড়ে উঠলো এক অদ্ভুত আত্মিক যোগাযোগ। 


মানস দা নেই, কিন্তু বড় বেশি করে আজ থেকে রয়ে গেল আমার কাছে, আমাদের কাছে। বহু মানুষের বহু স্মৃতির ফ্রেমে।


৫.

অর্থিতা মণ্ডল


২০০২ তে সাম্মানিক স্নাতক স্তরের পরীক্ষা শেষ করি। ২০০৩ সালে, আমি লেখাকেই আমার জীবনের প্রধান কাজ হিসেবে ভেবে নিয়েছিলাম। ছোটোবেলা থেকে লেখালেখি করা আর লেখাকেই ভবিষ্যতের মূল কাজ হিসেবে বেছে নেওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালে, আমার লেখার কাজের প্রস্তুতি পর্বের দিনেই পরিচয় হয় কবি মানসকুমার চিনির সঙ্গে। তাঁর আগেই পরিচয় ঘটেছে কবির নামের সঙ্গে। না, তখনো মানসদার কবিতা পড়িনি। পরিচয়ের পরেই শুরু হলো কবি মানসকুমার চিনিকে চেনার সঙ্গে সঙ্গে দাদা মানস কুমার চিনিকে চেনা। তিনি হয়ে উঠলেন আমার ভবিষ্যৎ অক্ষরকর্মী হয়ে ওঠার শুরুর দিনগুলির অনুপ্রেরক, উৎসাহদাতা, কবিতা লেখার স্নেহ - প্রশ্রয়ের আশ্রয় স্থল। সেই সময়ে, তমলুকে একটি অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। কথাসাহিত্যিক অনিল ঘড়াইও ছিলেন। সেদিন বড়ো স্নেহ করে 'বোন’ বলে ডেকেছিলেন আর তাঁরই সঙ্গে আমদের সাথে যাওয়া আমার মা বাবাকেও আপন করে নিয়েছিলেন। এরপর আমাদের বাড়িতে এসেছেন বেশ কয়েকবার। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর কবিতা নিয়ে কতো আলোচনা! নতুন বই বের হলেই উপহার দিতেন। একদিন কবির ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় ঘটলো, রেলের চাকরি থেকে বড়ো কম বয়সে ভিআরএস নিয়ে, খড়্গপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলেন। মানসিক আর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। না, কবিতা লেখা থেকে নিজেকে দূরে সরাননি, দূরে সরেননি পড়াশোনার জগৎ থেকেও। যোগাযোগ রেখেছেন আমার সঙ্গেও। মাঝে মাঝে পেতাম তাঁর লেখা কবিতা সংক্রান্ত দীর্ঘ চিঠি, বই। আমার লেখা পড়ে জানাতে ভুলতেন না। ফোনে কবিতা নিয়ে কথা বলতেন মাঝে মধ্যে কখনো। ২০১৫ তে আমার আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র 'কথাকই', আমাদের কিংশুক পত্রিকা আর শুভজিৎ বরকন্দাজের পানকৌড়ির একত্রিত উদ্যোগে বাংলা আকাদেমির জীবনানন্দ সভাঘরে অনুষ্ঠান করেছিলাম। এসেছিলেন আমাদের আমন্ত্রণে। অবশ্য তার আগেও আমাদের অনুষ্ঠানে এসেছেন। এটা ছিল আমার করা শেষ আয়োজন, তাই আমারই আমন্ত্রণে তাঁর এই আসাই শেষ আসা। 


তারপরেও তো যোগাযোগ ছিল। সম্ভবত ২০১৯ (না কি ২০১৮!) থেকে আমারই ভুলে ফোন নম্বর হারিয়ে ফেলি, আমার আর ফোন করা হয়নি। ওদিকে মানসদাও অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন ফোন করেননি, কবিতার আলোচনায় ভরা চিঠিও  পাঠাননি। তারপর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি ফোন নম্বর জোগাড় করে ফোন করে উঠতে পারিনি। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যে মনের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছিল না চাওয়া এক অপরাধ বোধে। শুনেছিলাম, অনুভব করেছিলাম মানসিক বিপর্যয়ে, শারীরিক অসুস্থতায় ভেতরে ভেতরে বড়ো একা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। 

 ১২' ই জানুয়ারি ২০২৪, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিটল ম্যাগাজিন মেলায় আবার দেখা হলো কবি মানস কুমার চিনির সঙ্গে, আমার মানসদার সঙ্গে। এই কটা বছরের যোগাযোগহীনতা, আমার মনের অনিচ্ছাকৃত অপরাধবোধ মুহূর্তে কেটে গেল মানসদার আপন করা হাসি মুখের সম্ভাষণে। কত গল্প, কত কথা, ছবি তোলা... নাহ্! একবারের জন্যেও ভাবিনি এটাই শেষ দেখা, সেদিনের কথাই শেষ কথা।  জীবনের কোন বাঁকে কার সঙ্গে দেখা হওয়া কোন মুহূর্ত যে শেষ দেখা হয়ে যায় তা বোধ হয় স্বয়ং ঈশ্বরও জানেন না! 


বাংলা কবিতার ইতিহাস কবি মানসকুমার চিনিকে মনে রাখবে আর আমার মনের ভেতর আমৃত্যু কবি মানসকুমার চিনির সঙ্গে সঙ্গে থেকে যাবেন স্নেহপ্রবণ অগ্রজ, যিনি আমার প্রস্তুতি পর্বের অনুপ্রেরণাদাতা, উৎসাহদাতা প্রিয় কবি।


৬.

আনন্দরূপ নায়েক


মানস দা! আপনি আর নেই?!

হঠাৎ এমন কথা মেনে নিতে কষ্ট হয় বড়। কত স্মৃতি.. কত কথা.. কত চিঠি.. উপহার দেওয়া কত ব‌ই.. কবিতা কিংবা ব্যক্তিগত.. মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। 


তারুণ্য ভরা সকালের কথা মনে পড়ে। অথবা এক একটা বিকেল‌। খড়্গপুর স্টেশনের ওভারব্রিজ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবুলাইন। রেল কোয়ার্টার। কবিতা মোনালিসা। 'তোমার কবিতা থাকছে, আনন্দরূপ'। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি। অদ্ভুত এক নস্টালজিয়া জড়িয়ে আছে সেইসব দিনগুলোকে ঘিরে। অনেকবার‌ই গিয়েছি সেই বাসস্থানে। সময়ের দিনে। অসময়ের দিনে। একা কিংবা কয়েকজন মিলে। 

কোন‌ও এক সন্ধের কথা আমার মনে থেকে যাবে চিরদিন। একসঙ্গে ফিরছি দুজনে। গাড়ির জানালা পেরিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে তখন। কবিতা কিংবা ব্যক্তিগত সব পরস্পর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ সুদূরে। 


বছর পেরিয়ে এসে কথা ক্রমশ ভিড় করত ফোনে। মাঝেমধ্যে চিঠি লিখতেন পরিচিত সেই গোটা গোটা হস্তাক্ষরে। আপনার হাতের লেখা আমি চিনি, মানস দা। কখন‌ও চিঠির উত্তর দিয়েছি। কখন‌ও উত্তর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আপনার চিঠিসব সঞ্চয়ে থাকল। থাকল‌ আপনার উপহার দেওয়া, আপনার প্রায় প্রতিটি কবিতা সংকলন। দেখা হলেই বড় আন্তরিকতায় তুলে দিতেন হাতে।


"প্রাণ ছিল, কিছুটা শরীরে দংশন

এসেছি শরনার্থী শিবিরে

কীর্তনীয়ার বেশে

এখানে কি বসন্ত আসে?


অজস্র মুখ বিচিত্র রঙে ভরা

কোন সন্ধ্যা তারাটি ধর্ষিত

কোথাও-বা জীবনের হাহাকারে

ফুটেছে পলাশ।


যেভাবে সন্ধ্যায় জমে ওঠে সুর

মায়ের দুঃখের মতো তুমি লুকিয়ে

থাকা চোখের জল, গোপন চোখের পাতায়

সন্ধ্যার শেষ আলো...

যেন বীজপত্র, কল্পলোক" -'শরনার্থী শিবিরে কীর্তনীয়া'


৭.

মঞ্জির বাগ


কখনো কখনো কিছু মানুষ যেন মায়াবী পথকে হেঁটে যায়। তারাই পৃথিবীতে থেকেও কেমন যেন এক এই পৃথিবীর মায়াবী মানুষ হয়ে যান। তাদের নিজস্ব এক মনন থাকে,থাকে নিজস্ব জগত। তাদের মায়াবী হাতের চিঠির জন্য আমরা অনেকেই অপেক্ষা করে থাকি। কবি মানস কুমার চিনি এমন একজন মানুষ যার চিঠির অপেক্ষায় আমরা বহুজনই থাকতাম। নতুন বই বেরোলে তিনি আমাদের পাঠাতেন, একটা চিঠি পাঠাতে ন। আমাদের বই পাঠালে পাঠ করে তার একটা চিঠি পাঠাতেন। তার হাতে লেখাটা বড় বড় অন্যরকম। সেই চিঠির অপেক্ষায় আমরা থাকতাম। সেই চিঠির আজ ঠিকানা বদল হলো। মানসদাকে শ্রদ্ধা জানাই। অনেক কিছু অদল বদল আমরা দেখেছি তার জীবনে। একটি জিনিস এক হয়ে থেকে গেছে সেটি হলো তার কবিতার প্রতি ভালোবাসা। শ্রদ্ধা ও নমস্কার।।


সুর বাঁশি।। মানস কুমার চিনি 


কৃষ্ণচূড়া রাধা চূড়ার পাশে তোমার 

ঘুমন্ত গ্রাম জেগে উঠেছে, চোখে চোখ 

দেখে বলি, কি আছে তোমার? 


যত কাছে আসো, ভাঙ্গে জলস্নান

অন্তরে পাক খাওয়া ভুল বুঝাবুঝি 

দুঃখ গান স্বপ্ন হয়ে ওঠে 


আমি সেই সুর বাঁশি যে প্রতিটি 

রাধার ঘুমে শোক হয়ে জেগে থাকি।



৮.

মৌমিতা দাস


শরীর টুকু নিয়ে বড় কষ্টে ছিলেন কবি। চোখে মুখে অনন্তকালের বিষন্নতা। বিষাদ তার নিত্য সঙ্গী। ফুরুস ফুলের মত চুল, চোখে একরাশ রহস্য, কখনো গভীর, কখনো বিষন্ন কখনো বিনয়ী। অথচ আচরণ পিতৃ সুলভ। বাইরের অনুষ্ঠানে খুব কম যেতেন। তবু গেলে একটা নিরাপত্তার বলয় দিয়ে রাখতেন। মানুষটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেই ২০০০ সালে। লোহার পাতের শহরে প্রথম বইমেলা। একঝাঁক তরুণের মধ্যে তিনি ছিলেন। তারপর বহুবার একসাথে লিখেছি, একসাথে কবিতা পড়েছি কবিতা শুনেছি, পিকনিক করেছি। তারপর একটা ঝড়। সব এলোমেলো। সে কথা লিখতে ইচ্ছে করছে না। সেই ঝড়টাই মানুষটাকে ভিতর থেকে শেষ করে দিয়েছিল। তবু ভিতরকার কবি বেঁচে ছিলেন। বিষন্ন চেহারায় কেবল চোখ দুটি বড় উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বল চোখের মানুষটার সঙ্গে বহুদিন কথা হয়নি। কথা হত তার কবিতার সাথে। কবিতায় থেকে গেলেন আমাদের মানস দা। বড়ো স্নেহ করতেন। বলতেন তোমার লেখায় কৃষ্ণা বসুর মত আগুন আছে বাঁচিয়ে রাখ। আর সব চলে গেলেও কবিতা যেতে দিও না। চলে গেলেন তারাদের দেশে। আজকাল ভালো লিখতে পারিনা। কিন্তু অগ্রজ কবির ভালোবাসা আর স্নেহ মাথায় রেখেছি। ভালো থাকুন আপনি মেঘের দেশে


তারপর ত্বক ফেটে দগ্ধ মাছটি

চাঁদকে সাক্ষী রেখে পরলোকে যায়।

ইহজাগতিক নৈশভ্রমন সেরে 

মেঘ উড়ে আসে সদর বারান্দায়

চাঁদকে সাক্ষী রেখে 

মানস কুমার চিনি


৯.

অর্ণব মিত্র                                 


বেশ কয়েক বছর দিল্লিতে কাটিয়ে খড়গপুরে ফিরে আসি ২০১৮ সালে। ফিরে খড়গপুর স্টেশনের বোগদার দিক দিয়ে সেদিন আসতে গিয়ে মানসদার কথা মনে পড়ে গেছিল। কবি মানস কুমার চিনি। এখানে বাবুলাইনে একটি রেল- কোয়ার্টারে থাকতেন মানসদা। আর আমি মানসদার কাছে মাঝে মাঝে পৌঁছে যেতাম। কারণ মানসদার রেল - কোয়ার্টার - এ ঢুকতেই বেড়া দেওয়া গেট পেরিয়ে যে বারান্দা সেটা আসলে একটি ছোট লাইব্রেরি। আর সেই কম বয়সে খুব একটা কবিতা বুঝতাম না, আসলে লাইব্রেরির বই - এর লোভেই মানসদার কাছে যেতাম।


দিল্লি থেকে ফিরে এসে জানতে পারি মানসদা বেশ কয়েক বছর হল আর খড়গপুরে থাকেন না। একদিন ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোনও করেছিলাম । আজ সকালে কলকাতার একটি হাসপাতালে মানসদার মৃত্যুর খবর পেয়ে আজ সেদিনের ফোনের কথাবার্তার মধ্যে কয়েকটি লাইন বার বার আমার কানে ভেসে আসছে - 'জানো অর্ণব, সংসার ছেড়েছি - খড়গপুর ছেড়েছি - আমার এখানো অবধি ২৩টি কবিতার বই বেরিয়েছে, আমি কবিতার জন্য সব ছেড়েছি'।


১০.

মিঠু মণ্ডল 


কবিতা বাগানের সাদা ফুলগুলো অগোছালো হয়ে ছিল অনেকদিন আগের থেকেই। আজ সেই অগোছালো সাদা ফুলে মিশে গেছে একবুক হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস। 


কবি মানস কুমার চিনি যখন কলম হাতে কবিতার মধ্যগগনে। আমি তখন সেই মাত্র খড়্গপুর সাহিত্য সভায় যাতায়াত শুরু করেছি। ব্যক্তিগত ভাবে কোনো কবি বা কাউকেই চিনি না। শুধু তাদের নামগুলো কখনো কানে এসেছে। কবিদের এই মহাজাগতিক ও স্বপ্নময় পৃথিবীতে তখনো সেভাবে হাতেখড়ি হয়নি আমার । অথচ তাঁদের সকলকে জানার, চেনার, শেখার বাসনা অন্তরে লালন করে চলেছি প্রতি মূহুর্তে। 


এই রকম সময়েই একদিন দেখা হয়ে গেল তাঁর সাথে। কবির নামটা বহুবার শোনা হয়ে গেছে ততদিনে। তাঁর লেখার সাথেও পরিচিতি হয়েছে। কিন্তু কবিকে দেখিনি তখনো। একদিন মেদিনীপুরের এক অনুষ্ঠানে কেউ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো -- ওই তো কবি মানস কুমার চিনি। অসুস্থ, অথচ অনেকদিন পর কবিতার টানে তিনি এসেছেন। তাকিয়ে দেখি অল্প দূরে একজন উস্কোখুস্কো ঝাঁকড়া চুলের একজন দাঁড়িয়ে। কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে বেশ কিছু বই। বেশবাস খুব সাধারণ। কয়েকজন ঘিরে রয়েছেন তাঁকে। উনি কথা বলছেন তাদের সাথে। একটু যেন অসুস্থ।‌ অথছ কবিতা বিষয়ক কোনো আলোচনায় কোনো জড়তা বা স্থবিরতা নেই। দূর থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রয়েছি। জানলাম তিনি মানস কুমার চিনি। খুব ইচ্ছে হল কবির সাথে কথা বলার। এতো জ্ঞানী, প্রতিভাধর মানুষটি আমার দুহাত দূরত্বে।‌ শুধু ইচ্ছে হলেই তো হবে না। দরকার সাহসটাও। এগিয়ে গেলাম ঠিক। কিন্তু কিছু বলবো কি। কথা বন্ধ হওয়ার উপক্রম । কাছে গিয়ে নমস্কার করতেই তিনি ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন -- আগে দেখিনি কখনো, নতুন লিখছো নাকি। খুব ভালো। তা তোমার নাম কি। কেমন লেখো। দেখি আমাকে শোনাও। কবিতা শোনাবো কি, মুখচোরা  আমি ভয়ে কাঁপছি ঠকঠক। তিনি বুঝতে পারলেন আমার হতভম্ব ভাব। বললেন --- লেখো, লেখাতেই থেকো।  তবে লেখার থেকেও পড়ো অনেক, তাহলে শিখতে পারবে অনেক কিছু। যিনি জ্ঞানী , উচ্চাসনে, এবং স্বমহিমায়, অথচ সাদরে টেনে নিলেন আমার মত এক আনকোরা কলমচিকে। এটি তার উদারতা , বড় মনের পরিচয়। যা আমাকে আজো আলোড়িত করে ভীষণ ভাবে। মনে আছে আমার সাথে তাঁর কথপোকথনের প্রতিটি কথা। 


তারপর অবশ্য খুব বেশি দেখা হয়নি। তবে যখনই হয়েছে তাঁর সেই হাসিমুখ আর কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা আমাকে নতুন করে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে শিখিয়েছে। তাঁর বলিষ্ঠ কলম নিয়ে কিছু বলার স্পর্ধা আমার নেই । এটা জানি, কবির শরীরের পার্থিব মৃত্যু হয়, মৃত্যু হয়না কবিতা ও তাঁর যাবতীয় সৃষ্টির।‌ তিনি তার সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে রইলেন সকলের কাছে।‌ তাঁর লেখা দিয়েই শ্রদ্ধা জানালাম। ভালো থাকুন অমৃতলোকে কবি মানস কুমার চিনি।


আমার যন্ত্রনায় জেগে থাকে 

তোমার সহস্র স্বপ্ন 

কখনো কান্না হয়ে ফোটে 

ভাতের থালায়।

বাঁচার শর্ত ছিল ধানের গোলায় 

যখন ঘাম হয়ে রক্ত ঝরে পড়ে 

নিজের মুখ আয়নায় চিনতে পারি না।

তোমার মোবাইলে তখন 

 কত ইচ্ছে ডানা মেলে।।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...