Sunday, 30 June 2024

আমার ভিতরে একটি শালিক বাস করে // কোরাস ১৮৪


 

আমার ভিতরে একটি শালিক বাস করে

তাহমিনা শিল্পী


দূরে কোথায় কে যেন কাঁদছে!হয়ত আর কেউ নয়,কেবল আমিই শুনছি সেই কান্নার শব্দ।সারা সকাল-দুপুর কাজ করে ক্লান্ত হয়ে,মধ্যাহ্নভোজন সেরে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুমিয়ে পড়বে আরও অনেকেই। তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।তাই বলে কান্নার শব্দ শুনতে পাবে না? 


এতেও বা আশ্চর্য হবার কী আছে? সব কান্না তো সবাই শুনতে পায় না।ওই তো, ওই, আবার শুনলাম। একবার নয়,কয়েকবার শুনলাম।কড়িডোর ধরে হাঁটছি আর ভাবছি।ভাবতে ভাবতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।

কী দেখছি? আদৌ কিছু কি দেখছি? নাকি দেখছি না?

কিছু কি খুঁজছি? নাকি খুঁজছি না? 

কারো অপেক্ষায় আছি? কারো কি আসার কথা? 

আপাতত এসব নিয়ে ভাবছি না।

আমার কেবল দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।


আমি মিথিলা! বাবার ভালোবাসার বারবি ডল। মায়ের আদরের দুলালী। আর ভাইয়ের স্নেহসিক্ত দস্যি রাণী। সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট,সমাজের তথাকথিত নিয়মের শিকলে বাঁধা এক নারী। আমি, আমার আমিকে প্রকাশ করতে পারি না। কোন কিছুকেই নিজের বলে ভাবতে পারি না। আমাকে আমি বহন করতে পারি না।এমনকি নিজেকে মানুষতো নয়-ই, একজন নারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না।অমুল্য এই জীবনকে আলোয় আনতে পারি না।


আমি শুধু নিজেকে একটু একটু করে আরো অন্ধকারে ধাবিত করতে পারি।ভালোবেসে তোমাদের ভালো-মন্দের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারি।তোমাদেরকে সম্মানিত করতে নিজের আত্মসম্মান বিলিয়ে দিতে পারি।আর পারি বেলাশেষে অলস দুপুরে,বিষন্ন বিকেলে,কিংবা নির্ঘুম মধ্যরাতে নিজের সাথে কথা বলতে।মনের ইচ্ছে গুলোর জাবর কাটতে।


এই আমি মানে আমরা,নারীরা।দিন শেষে সখিনা, নোরা, দীপালী কিম্বা মিথিলা সবাই আমরা এক। আমাদের একমাত্র পরিচয় আমরা নারী।আমরা পারি না মানে, আমাদেরকে পারতে দেয়া হয় না। তুমিই আমাদেরকে দাবিয়ে রাখো। তুমি মানে পুরুষ! তুমি সমাজপতি।তাই সব নিজের বলে ভাবতে পারো।নারীকে তোমার দখলে রাখতে পারো।


জীবনই আমাকে চিনিয়ে দেয় অন্দরমহল।প্রতিনিয়ত বুঝিয়ে দেয়,আমার আমিত্ব থাকতে নেই! আমাকে শিখিয়ে দেয় আমি নারী,মানু্ষ নই।চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই যে পুরুষ!এরা সমাজপতি। স্বামী তোমার পরমেশ্বর! তোমার  উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার।সে যেমন ইচ্ছে,তোমাকে চাইতে পারি।যেমন খুশি চালাতে পারে।তোমার সকল সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে।বিদ্যা বুদ্ধি যতই থাকুক,বিনাবাক্যে তোমাকে সব মানতে হবে।


এভাবেই রোজ মিথিলার নিজের সাথে নিজের কথোপকথন চলে।এভাবেই নিজেকে দেয় সামান্য সময়।নিজের সাথে সব ভাললাগা,মন্দলাগার সহবাসে কাটিয়ে দেয়া এক জীবন।


একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করতাম।ভালো বেতন।বছরে তিনটে ইনক্রিমেন্ট।কিন্তু বিয়ের পর কেউ আর চাইলো না আমি চাকরিটা কন্টিনিউ করি।ফুল টাইম বাড়িতেই থাকি।হোম মেকারের ভূমিকায় অভিনয় করি।হাড়ি-কড়াই ধুঁই, ঘর ঝাড়ু দেই, কাচাকুচি করি, ঘর গোছাই, বারান্দাবাগানের গাছগুলোতে দুইবেলা জল দেই, আগাছা পরিষ্কার করি, রান্নাবান্না করি, বেড়েকুড়ে খাওয়াই।শশুর-শাশুরির সেবা করি।ছেলেকে পড়াই,হোমওয়ার্ক করাই।এসবের ফাঁকেফোঁকরে এদিক-সেদিক নিজের জন্য একটুখানি সময় খুঁজি।মন ভালোর অনুষঙ্গ হাতরে বেড়াই।


আমার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ ও পশ্চিমের বারান্দা দুটো একান্ত আপন হয়ে ওঠেছে।পশ্চিমের বারান্দায় আমার প্রিয় গাছগুলোর সাথে আত্মীক সময় কাটাই। এই বারান্দা থেকে দেখা যায় অজস্র পাখির মেলা।তারা ভোরে জেগে উঠে গান শোনায়।সন্ধ্যে নামার আগে বেশ অনেকক্ষণ আকাশচুম্বী দালানগুলোর ছাদ,চিলেকোটা ছুঁয়েছুঁয়ে ডানার গানে বাতাসে মায়া ছড়িয়ে গৃহবাসী হয়।


দক্ষিণের বারান্দার দুইদিকে রাস্তা,সামনের দুটি প্লটে এখনও বাড়ি ওঠেনি,তুলনামুলক উন্মুক্ত।এখান থেকে পথচারী, হকার, ফেরিওয়ালা, সবজিওয়ালা সহ নানান কিসিমের লোকের দেখা পাই।বিকেলের আকাশে বেশ কয়েকটি ঘুড়ি ওড়ে।কোন কোন বাড়ির ছাদে ছেলেমেয়েরা কিচিরমিচির করে।এইসব দেখতে আমার ভারী ভালো লাগে।


গত কদিনে অবশ্য আমার বিনোদনটা  একটু ব্যতিক্রম।ভালো হয় যদি বলি,আমার হারিয়ে যাওয়া দিনের রূপকথার গল্পেরা নতুন সংস্করণে ধরা দিয়েছে আমার চোখে।


আমার ফ্ল্যাটের ডানদিকের বাড়ির তিনতলার পনের/ষোল বছর বয়সী মেয়েটি খানিকক্ষণ পরপর বারান্দায় আসছে।এলোমেলো হাত নাড়ে,অকারণে হাসে,গ্রিল ধরে দোল খায়।তার হাতের ইশারা সামনের বাড়ির খোলা জানালায়।সেখানে কয়েকজন ব্যাচেলর ভাড়া থাকে।তাদেরই একজন তার হাসির প্রতিউত্তর দেয়, হাত দিয়ে টেলিফোনের ইমোজি দেখায়, উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দেয়।


এই দৃশ্য আমার ভালো লাগে।এসব মন্দ নয়।বয়সের সৌন্দর্য।বহুদিন এমন দৃশ্য দেখিনি।আবার কখনও দেখতে পাবো ভাবনার বাইরে ছিল।ফেসবুক,ইন্সট্রাগ্রামের যুগে এসব কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।নতুন প্রজন্মের কাছে এগুলো তো ব্যাকডেটেড ট্রেন্ড।তাহলে ওরা কেন চর্চা করছে! এই বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে মুগ্ধতা আমাকে ঘিরে ধরে।ওদের মাঝেই ফিরে পাই আমার স্মৃতিগন্ধা স্বর্ণবিকেল।


রাজকন্যা রাপুনজেলের মত দীঘল কালো কেশ নেই,ছিল না কোনকালে।কোন ডাইনিবুড়ি বন্দি করে রাখেনি দূর বনের দরজা বিহীন আকাশচুম্বি কোন ঘরে।চুল বেয়ে উদ্ধার করতে আসেনি পথভোলা কোন রাজপুত্তুর।


তাই বলে কি ছাদে গিয়ে চুল শুকোতে মানা? একদম না।


রোজ বিকেল হলেই ছেলে-বুড়ো সবাই দলবেঁধে ছাদে উঠতাম।মহল্লার সবগুলো ছাদের ছিল একই চিত্র।এবাড়ি-ওবাড়ির আন্টি,চাচীরা আচার-চাটনি বানানোর আলোচনা করতেন।নতুন শাড়ি-গয়নার গল্প করতেন।কিশোর-কিশোরীর দল হৈচৈ করে ঘুড়ি উড়াতো।পুচকোরা ছাদময় ছুটোছুটি করতো।আর সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বড়আপু-ভাইয়ারা চোখেচোখে মনের ভাব প্রকাশ করতো।কখনও আবার একছাদ থেকে অন্যছাদে ঢিল ছুড়ে পাঠাতো চিরকুট।


একদিন এক ঢিলকাব্য উড়ে এলো আমাদের ছাদের ঠিকানায়।সদ্য কৈশোর পেরুনো আমরা প্রায় সমবয়সী তিনকন্যা গল্পে মশগুল।লক্ষভ্রষ্ট ঢিলটি গিয়ে পড়লো দোতলার চাচীর পায়ে।সেকি রক্তারক্তি কাণ্ড!কোন বাড়ির ছাদ থেকে এসেছে ঢিল,কাকে পাঠিয়েছে এসব বোঝার আগেই চাচীর চিৎকারে সব ছাদের বড়ভাইয়েরা এক নিমিষেই লাপাত্তা।আর চাচী বকতে বকতে বর্ষার গতিতে চিরকুট সমেত ঢিলটি ছুড়ে দিলেন শূণ্যে।ঘুরপাক খেতে খেতে অবশেষে তার শেষকৃত্য হলো ড্রেনের পচা জলে।


আমাদের সমবেত হাসির ঢেউয়ে দুলে উঠেছিল আকাশ।


আমার জীবনেও একদিন রাজপুত্তুর এলো।বাবার পছন্দ করে দেয়া রাজপুত্তুরের সাথে আমার দেখা হল বিবাহ আসরে।কথা হল,একেবারে বাসরঘরে।


প্রতিটি দম্পতির বাসরঘরের কিছু পুতুপুতু গল্পের স্মৃতি থাকতে হয়। মুলত ওটা দাম্পত্য জীবনের চমৎকার শুভারম্ভ।যেমন, তখন শ্রাবণ মাস। আমাদের বিয়ের রাত।সন্ধ্যা থেকে একটানা বৃষ্টি ঝরছে।বাড়ির সামনের রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে গেছে।অতিথিদের অনেকেই জল ভেঙে বাড়ি ফিরতে পারেনি।গোটা বাড়ি জুড়ে আনন্দের শোরগোল।ভীড় সামলে রাত একটায় তুমি বাসরঘরে এলে। বললে- বৌরাণী, একদিন এইরকম বৃষ্টিতে আমরা সমুদ্রস্নান করবো।


যেন তুমি অবধারিতভাবেই জানতে সমুদ্র এবং বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়।আমি রোমাঞ্চিত হলাম।হঠাৎ দমকা বাতাসে যেমন করে ফুল ঝরে পরে আমিও তেমন করে এক পলকে তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম।


আমাদের শ্রাবণ মাসেই বিয়ে হয়েছিল।সে রাতেও বৃষ্টি ঝরেছিল খুব।অথচ বাসরঘরের পুতুপুতু কোন গল্পের স্মৃতি নেই।এখনও স্পষ্ট মনে আছে,ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রথমেই তুমি বলেছিলে- তোমার একটাই চাওয়া।এখন থেকে বাবার বাড়ির কথা ভুলে গিয়ে আমি যেন তোমার, তোমার বাবা-মা,দাদী আর ছোটবোনের মনের মত হয়ে উঠি।কখনও কারও কথার অবাধ্য না হই।সবার প্রয়োজন,ভালো-মন্দের খোঁজ রাখি।


একবারও বলোনি,আজ থেকে এটাই তোমার বাড়ি।যদি বলতে তাহলে এবাড়িটা আমাদের হত।আমরা সবাই সুখে দুঃখে পারস্পারিক নির্ভরশীলতায়, সহযোগিতায় বাড়িটাকে স্বর্গোদ্যান বানাতাম।তবুও আমি তোমাদের সবার মনের মত হয়ে উঠেছি।তোমাদের বাড়ির যোগ্য বৌ হয়েছি।সকলের প্রিয় হতে পেরেছি।তোমার অহংকারের কারণ হতে পেরেছি।

শুধু আমি এখনও তোমাদের হতে পারিনি।

আমি আমারও হতে পারিনি।


যখন রোজ স্নানঘরে শাওয়ারের জলে আমি বৃষ্টিস্নানের স্বাদ নেই।ঘুমোতে যাবার আগে পর্দা টেনে দেবার ছলে এক ঝলক আকাশ দেখে নেই।তখন আমি আমার হয়ে উঠার ভান করি।


হ্যাঁ,আমি নারী।আমি মিথিলা বলছি।আমি-ই বাবার আদরের বারবিডল, মায়ের পাগলি মেয়ে,ভাইয়ার দস্যিরাণী।একদিন যেই আমি সারাক্ষণ বকবক করে বাড়ির সবাইকে অস্থির করে রাখতাম।আজ তার কথা শোনার কেউ নেই।এবাড়ির সবাই যখন দুপুরের খাবারের পর ভাতঘুমে অচেতন থাকে।তখন চুপিচুপি বাবার কিনে দেয়া সেই ছোট্ট নূপুরের গায়ে হাত বুলাই।আর নিজের সাথে অনবরত কথা বলে যাই।


মাকে বলি,তুমি শিখিয়েছিলে দিনের বেশিরভাগ সময় মেয়েদের চুলোর কাছাকাছি থাকতে হয় তাই সংসারের উত্তাপ তাদের পোড়াতে পারে না।যদি না শিখাতে হয়ত জীবনটা অন্যরকম হতো।কেবল নাকফুলের মায়ায় রোজ বেঁচে থাকতে হতো না।


ভাইয়া,সবসময় তোর জিনিসে জবরদস্তী ভাগ বসাতাম বলে বলতি,কবে যে তুই বিদায় হবি।যদি তোকে ওভাবে না রাগাতাম।তাহলে হয়ত আজ শিকড়হীন হতাম না।


বাবা,আমার ছোট্টছোট্ট পায়ে যে নূপুরটা তুমি পরিয়েছিলে।যেই নূপুরধ্বনি তোমাকে আনন্দের জোয়ারে ভাসাতো।আজ সেটাই অদৃশ্য বেড়ি হয়ে আমায় বেঁধে রেখেছে।


কতদিন বাড়ি যাইনি,দেখিনি তোমাদের।

প্রিয় নদী,কতদিন শুনিনি তোমার জল কলরব।


মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সবুজ ডিম লাইটের আলো অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে উঠে।ঘরের সবকিছু তখন স্পষ্ট দেখা যায়।আমার বুকসেলফে রাখা ঘুম-অঘুম ও দুঃস্বপ্নের গল্পটি কথা বলে ওঠে।বলে,বলতে পারো-অসুখ করে কেন? স্বপ্নেরা আগুন হয়,হৃদয় পোড়ায় কেন?


মাথার উপর জোরে শোঁ শোঁ করে ঘুরতে থাকা সিলিংফ্যানটার দিকে আমি নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকি।কিন্তু, ফ্যানটাকে সিনেমার স্লোমোশান দৃশ্যের মত লাগে।আমি ঘামতে থাকি, ঘেমে নেয়ে চুপচুপে হয়ে যাই।


স্বপ্নটা প্রায়ই দেখি। আজও দেখলাম।প্রতিবারই স্বপ্নের একই জায়গায় এসে ঘুমটা ভেঙে যায়।ঘুম আর স্বপ্ন দুটোই ভেঙে গেলে ঢকঢক করে এক বোতল জল খাই।পাশ ঘুরে তোমাকে দেখি।বিকট শব্দে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো।আমি উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াই.... 


ব্যালকনিতে জেগে থাকা নিঝুম রাতের মন কেমনিয়া সময়ে হঠাৎ প্যাঁচার ডাক ভীষণই এলোমেলো করে দেয়।যেন পুকুরের শান্ত জলে কেউ একটি ছোট্ট ঢিল ছুড়ে দিলো।আর জলে ভেসে থাকা পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে সেই জলে বাড়িয়ে দিলো ঢেউয়ের দোলা।অমনি আমি ঘষেমেজে স্মৃতিকে চকচকে করতে লেগে গেলাম।


বর্ষায় যৌবনপ্রাপ্ত জল থৈথৈ কুমারনদটা ফুলে-ফেঁপে উঠলে তার রূপসৌন্দর্য অনেকটাই বেড়ে যায়।আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরের বাজারের ঠিক মাঝ বরাবর সোনালী ব্যাংকের পাশ ঘেষে যে সরু রাস্তাটা এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে নদীর দিকে তার শেষ মাথায় নৌকো ঘাট।প্রায় গোটা তিরিশেক নৌকো বাঁধা থাকে ঘাটে।কোনটি খেয়া পারাপারের,কোনটি পাট বোঝাই,কোনটি আবার দূর গায়ের যাত্রী পরিবহণের।


মাঝি,খালাশিদের হাঁকডাক, লোকের যাওয়া-আসা, শোরগোলে ব্যস্ত ঘাটটির এককোণে বড় দুটো সিমেন্টের চাঈয়ের উপর বসে থেকে প্রায়ই এই দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন মন হারাতো।তখন একজন আমার মনের কথা বুঝতে পারতো।


আমার মেজমামা।শান্ত স্বভাবের ঘরকুনো লোক।বন্ধুবান্ধব খুব একটা ছিল না।বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতো।কাছাকাছি বয়সের না হলেও আমাদের দারুণ বন্ধুত্ব।বেড়াতে যাওয়া, মেলায় যাওয়া, সার্কাস-সিনেমা দেখার মত শখগুলো মেজমামার আস্কারাতেই মিটতো।ঠিক সেভাবেই আমার নৌকাভ্রমনের শখটাও মিটতো মেজমামার বদৌলতে।


নৌকা রিজার্ভ করে আমরা ঘাট থেকে অনেকটা দূরে নৌবন্দর টেকেরহাট পেরিয়ে সেন্দিয়াঘাট পর্যন্ত যেতাম।সে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ।নদীতে তখন বেশ শুশুক দেখা যেত।স্রোতের উল্টো দিকে তারা চকচকে কালো পিঠ উঁচিয়ে ডিগবাজি খেতো।একটা, দুটো,তিনটে.....আমি গুনতে থাকতাম কয়টা শুশুক দেখতে পেলাম।কোনটা কতবার ডিগবাজী খেলো... কোনটা বেশি চঞ্চল... এইসব দেখতে দেখতেই আমরা সেন্দিয়া পৌঁছে যেতাম।


সেন্দিয়াঘাটের দুইদিকে কুমার নদ।একদিকে নালাখাল।অনেকটা দ্বীপের মত।আমার যখনই ওখানে যেতাম,মামার কাছে জানতে চাইতাম সেন্দিয়া নামের রহস্য কি? কেন এই জায়গার নাম সেন্দিয়া হল? 


মেজমামা প্রতিবারই নতুন নতুন গল্প বানাতেন এর নামকরণের।এরমধ্যে আমার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল যে গল্পটি সেটি হল- নাবিক সিন্দবাদ একবার এই পথে যাচ্ছিল।তখন একটি শুশুক জাহাজের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে পথ আটকে দিলো।সবাই মিলে খুব চেষ্টা করেও কোনভাবেই শুশুকটাকে সরাতে পারেনি।অগত্যা সিন্দাবাদ এই ঘাটে নোঙর করেছিল।তখন থেকে এর নাম সিন্দাবাদের ঘাট হয়ে গেলো।কিন্তু মানুষের মুখেমুখে পরিবর্তণ হতেহতে এখন এর নাম সেন্দিয়াঘাট।


সেন্দিয়ার পূর্বপাশের নালাখালে নৌকো থামলে সিঁড়িপথ বেয়ে উপরে উঠে গেলেই চমৎকার সানবাঁধানো ঘাট।পাশেই বুহুদিনের পুরনো বটগাছকে ঘিরে হাঁট।সেখানে নানারকমের সওদা নিয়ে আসতো লোকে।বেঁচাকেনা শেষে সন্ধ্যায় ফিরতো নিজ নিজ গাঁয়ে।


আমরা একটা রেঁস্তোরায় বসতাম।গরমগরম দানাদার,মুচমুচে নিমকি,আর মালাই চা খেতাম।তারপর সাপ আর বানরের খেলা দেখতাম।কোনকোন দিন টগিও দেখতাম।খেলনা কিনতাম......


আজ সময়ের পরিহাসে বদলে গেছে আমার জীবন নদীর বাঁক!


উত্তর দিক থেকে হু হু করে উড়ে আসে একরাশ হিম বাতাস।

শান্ত বাতাসে মায়ের বুকের গন্ধ পাই।মায়ের কথা স্পষ্ট শুনতে পাই।অনেক দূর থেকে মা ডেকে বলছে,জেগে ওঠ মিথিলা।মিথিলা জেগে ওঠ।জেগে ওঠ...


আমি জেগে উঠি।


সেদিন থেকেই বুঝলাম অস্পষ্ট ছায়াকেই তোমরা আমি ভাবো।সেদিন থেকেই পুরনো পারদ উঠে যাওয়া আয়নায় নিজের মুখখানা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি।একবার দুবার নয়,বারবার দেখি।

প্রতিবারই দেখি, আমি একটা জলজ্যান্ত মানুষ!


এখন আমি বুঝে গেছি,আমাকে ঝাপসা ছায়া রূপে দেখতেই তোমরা আনন্দ পায়।চকচকে আমিটাকে তোমরা ভয় পাও। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবো।


আমার ভিতরে একটি শালিক বাস করে।একটি খয়েরী রঙের শলিক।তার ডানার পালক অনেকটাই শক্ত।বহুদিন তার সাথে আমার দেখা নেই।কিন্তু এখন সে আবার ফিরে এসেছে।সেদিন থেকে আমি বুঝতে পারলাম অন্যের সুখের জন্য নিজের বিশ্বাসকে ছাইয়ের মত উড়িয়ে দেয়া যাবে না।


ঠিক সেদিনই,সেই মুহূর্তেই শালিকটি ফিরে এলো।এখন সে তোমাদের দেখলেই কর্কশ স্বরে হাসে।অট্রহাসি......


শালিকটি যত জোরে হেসে ওঠে,আমার অবয়ব ততই স্পষ্ট হয়।


এ এক অদ্ভুত ম্যাজিক!



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Sunday, 23 June 2024

মহুয়া ব্যানার্জী এর কবিতা // ই-কোরাস ১৮৩


 

পুরনো অ্যালবাম

মহুয়া ব্যানার্জী 


১.

পুরনো অ্যালবামে স্মৃতির রূপরেখা,

পাড়া বেড়ানো সময়গুলো মধ্যভাগে 

বিলুপ্তপ্রায় চড়ুইয়ের মত বিক্ষিপ্ত ওড়াউড়ি করে,

দুরবর্তী স্টেশনে ট্রেন ছেড়ে গেলে চাকার 

শব্দটুকু হারিয়ে ফেলার ব্যথা বয়ে আনে!

অচেনা হতে হতে হঠাৎ করে আবার 

কি পরিচিত গণ্ডিতে ফিরে আসা যায়না? 



২.

পুরনো অ্যালবাম ঠিক যেন প্রাচীন 

শরিকি বাড়িটি, প্রতিটি সময়ের গল্প

ধরে রেখেছে পাতায় পাতায়।

শীর্ণ ঠাকুমার শেমিজ থেকে 

 ঝুলে পড়া শুষ্ক স্তনের ছবিতে 

তার দীর্ঘ লড়াইয়ের গল্প লেখা হয়।

নববধূ বরণের ছবিটিতে পেছনের পর্দার 

মধ্যবিত্ত দৈন্য নজর কাড়ে,

 বধূটির উজ্জ্বল মুখ একদিন ওই পর্দার 

মতই ফ্যাকাসে হতে হতে মা ঠাকুমার 

ছবির মত অপ্রস্তুত হবে ! 

আত্মীয়স্বজন বড়ছেলের বন্ধু আশ্রিতা পিসির মত কেউ পাড়া প্রতিবেশী সব 

নিয়ে পুরনো অ্যালবাম ভরে থাকে,

ভরে রাখে একাকীত্বের ফাঁক। 

চাঁদের মত দাগছোপ নিয়েও আকর্ষণের  কেন্দ্রে 

থাকে সব পুরনো অ্যালবাম। 



৩.

পুরনো অ্যালবামে জলপড়া দাগ,

মিছিলের স্মৃতি সব ঝড়ের আকাশে 

অমলিন উদ্ধত থাক। 

সাদাকালো ছবি অচেনার ভীড়,

বেপরোয়া রোয়াকের উত্তাল গল্পরা

পাতায় পাতায় স্থির।

লাল স্কার্ট ফুলছাপ দু'বিনুনি ঘিরে 

সাইকেল দ্রুতগতি টিউশনির রাস্তায় 

আসবে কি ফিরে? 



৪.

সেই কবে তাজমহল দেখেছিলাম, 

তার চেয়েও মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছি

বাবার বন্ধুর পেনট্যাক্স ক্যামেরা।

চটপট সবাইকে দাঁড় করিয়ে 

ছবি তুলছিল কাকু, আমাকে ডাকেনি।

আমি হ্যাংলার মত তাকিয়ে ছিলাম।

তাজমহলের দিকে নয়

যাদের ছবি তুলছিল তাদের দিকে! 

কালো মেয়ের সাদাকালো ছবি খুব 

কি খারাপ হয়? কে জানে।

বছর মাস দিন গড়ালে আবার তাজমহলের সামনে একা দাঁড়িয়ে।

চকচকে মুখে বাবা ছবি তুলছে একটার পর একটা, মেয়েটা খুব ছবি তুলতে ভালোবাসে। 

পুরনো অ্যালবামে সেই সব ছবিগুলো ভীষণ রঙিন এত বছর পরেও। 



৫.

প্রথম পাতায় বিয়ের ছবি দুটোয় হাত বোলায় যুবতী, মঙ্গলসূত্র আর সিঁদুরে 

নিজেকে এত অপরূপ লাগছে...

পরের পাতাগুলোয় সুখী সংসারের 

রঙবেরঙের চিত্রপট উপছে পড়া 

সুখের গল্পগুলো বলছে...

শেষ পাতাটা এখনও ফাঁকা!

যুবতীর বেরঙীন শাড়ি, ফাঁকা সিঁথি 

আর খুলে রাখা মঙ্গলসুত্রের গল্প 

বলার ছবিটা একটু পরেই  

জায়গা পাবে। 

ইলেকট্রিক চুল্লীতে ভালোবাসার লাশ

পুড়তে যতক্ষণ, 

তারপর এই পুরনো অ্যালবাম যুবতীর 

একমাত্র আশ্রয় হবে।

                   ……………….  



সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - অভিষেক নন্দী

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Sunday, 16 June 2024

বাংলা কবিতায় নারীর ক্ষমতায়ন // ই-কোরাস ১৮২

 



বাংলা কবিতায় নারীর ক্ষমতায়ন

দুঃখানন্দ মণ্ডল 


ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী শিকাগোতে মহাধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে গেছেন। বক্তৃতা শুরু করতেই কিছু আমেরিকা মহিলা বলে উঠলেন - আপনি কি ধর্মের কথা বলবেন! আপনার দেশে কালীকে উলঙ্গ অবস্থায় পুজা করেন। আপনারা ভারতীয়রা নারী সম্মান করতেই শেখেনি। না সেদিন ড. ব্রহ্মচারী তাঁর বক্তৃতা মঞ্চ ছেড়ে চলে আসেনি। বরঞ্চ এই প্রশ্ন যাঁরা করেছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন; মায়েরা আগামীকাল আপনারা আমাকে একটু সময় দিন আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেবো। পরেরদিন যথা সময়ের ঐ প্রতিবাদী নারীরা এসে উপস্থিত হলেন। ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী শুরু করলেন সেই কথা। মায়েরা আপনারা যে কথা বলেছেন তা একেবারেই সত্যি। কিন্তু মা একজন সন্তানকে রক্ষা করার জন্য একজন মায়ের কি কি ভূমিকা থাকতে পারে? উপস্থিত মায়েরা তাদের মতো করে বলতে লাগলেন। ব্রহ্মচারী সবশেষে নিজের দেশের সনাতনী ধর্মকে পাশে রেখে বললেন; রক্তবীজের মতো শত্রুর জন্ম হয়। তারা এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আাট হয়। এই রক্তবীজ শত্রুকে নিধনযজ্ঞ মা উলঙ্গ হয়েছেন। মা তার সন্তানদের রক্ষা করার জন্য নিজের লজ্জাকে দূরে রেখে নিধনযজ্ঞে মেতেছিলেন। আমেরিকার প্রতিবাদী মায়েরা সেদিন মাথা নত: করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির কাছে। 

প্রথমের বলে রাখি আমি একাডেমিক বক্তৃতা নয়। আমি আমার মতো করেই আলোচনা করবো কবিতায় নারীর ক্ষমতায়ন। কখন কখন এই ক্ষমতায়ন কশব্দটিকেও উপেক্ষা করে কিছু বলার চেষ্টা করবো। চলে যাই রবি ঠাকুরের কাদম্বরী দেবীর কথায়। হ্যাঁ কাদম্বরী দেবী। এক অভিমানী মানুষ। অভিমান তাকে আত্মহত্যা করতে সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু তিনি সর্বক্ষণ পূজা করে গেছেন রবি ঠাকুরকে। কখনোই বলে উঠতে পারেননি তাঁর যন্ত্রণার কথা, বলতে পারেননি আমি আমার জীবনের থেকেও আপনাকে ভালোবাসি। সে জানতেন রবিও তাঁকে ভালোবাসেন। নাহলে কখনোই চিঠিতে লিখতেন না "প্রিয় ছুটি"। আসলে কবি তো সবার। বোধহয় এটি মানতে পারেননি তিনি। আমি সে বিতর্কে যাবো না। কাদম্বরী দেবী খুব গর্ব করতেন মানুষটিকে নিয়ে। কিন্তু সে কথা কখনোই প্রকাশ করতে পারেননি। কেন পারেননি তাও তিনি জানতেন না। কবি সুবোধ সরকার এর লেখা "কাদম্বরী দেবী আপনাকে" কবিতায় লিখছেন- 

"সেদিন দুপুরে রবি এসেছিল, সিঁড়ি দিয়ে উঠে তেতলায়

ঠাকুর বাড়িতে তখন ছিল না কেউ

চৈত্র মাসের দীর্ঘ দুপুর কি কথা বলল আপনাকে?

গভীর রাতের ঐ জোঁড়াসাঁকো কি কথা বলল আপনাকে?

ভোরের আগে ঘর ছেড়ে উঠে স্বামীর বাহু ওপাশে সরিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতেন

মৃত্যু এসে কি আপনার চুলে হাত রেখেছিল? মৃত্যু বলেছে তোমাকে আমার প্রয়োজন!

সকাল সাতটা স্বামীর সঙ্গে মুখোমুখি বসে টিকোজি টি পট খুব ভালো কাপে দার্জিলিং 

কেন মনে হতো চা নয় চা নয় চা নয় একটু একটু বিষ পান করে চলেছেন!"

প্রশ্ন হলো কাদম্বরী দেবীর মনে এই বেহাগ সুর কেন?  কেনই বা তাঁর সুইসাইট নোট! আসলে একজন নারীর কাছে তাঁর সর্বস্ব হলো তাঁর সংসার, তাঁর পরিজন, তাঁর মনের মানুষটি। কিন্তু কখনো যদি তাঁর মনের মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে অভিমান তখন থেকেই শুরু হয় বেহাগী সুর। যে সুর মৃত্যুকে ভয় পায় না। আমরা যদি কবিতায় লক্ষ্য করি তাহলে তা দিব্যমান হবে আমাদের কাছে। সেই আদিকাল থেকে লেখা হয়ে চলে নারীদের যন্ত্রণার কথা, নারীদের মনে কথা, নারীদের মনে দাগ হয়ে থাকা কথা। সেই কবিতা কখনো নারীর কলমে কিংবা কখনো পুরুষ কবির কলমে উঠে আসে। তবে নারীর কলমে উঠে আসা কবিতা এবং সেই কবিতা তাঁদেরকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তা নারী সমাজকে সমাজের কাছে মেরুদণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বাংলাসাহিত্য। 


কবি কবিতা সিংহ এবং কবি রাজলক্ষ্মী দেবী- বাংলা কবিতার যাত্রা পথে পঞ্চাশের দশকে নারীকবির ভাষ্যে স্বাধীন মুক্ত চিন্তা, তেজস্বিতা, আপসহীন দৃষ্টিতে কবিতা ভুবন উচ্চকিত করেছেন রাজলক্ষ্মী দেবী। একজন কবি নারী হিসেবে কবিতার ছত্রে ছত্রে ভাষা দিয়েছেন নারীর হৃদয়কথা, নারীর যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং অনুভবের বর্ণমালা। সেই নূতন সৃষ্টি স্রোতে কবিতা সিংহের আত্ম আবিষ্কার ছিল আরও সচেতন আরও সংবেদী। "আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ" - এই আত্মমগ্ন উচ্চারণ কবিতার যা প্রাথমিক শর্ত, নারীর কলমে তার প্রকাশ ঘটেছে অনেক বিলম্বে। কেন বিলম্বে ঘটেছে তা নিয়ে অনুসন্ধান-বিশ্লেষণ হয়েছে। গবেষণাও হয়েছে। মহিলা কবিদের ইতিহাসও লিখেছেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। বিশশতক থেকেই বাংলা কবিতা চর্চায় সাবলীলভাবে অনেক নারী এগিয়ে এসেছেন। কবিতা পাঠকের কাছে অন্যজীবনের, অন্য যাপনের অনুভূতি শব্দমাসলায় তুলে ধরেছেন। সে প্রয়াসে বাংলা কবিতার ইতিহাসও সমৃদ্ধ হয়েছে। আমি চেষ্টা করবো নারীদের সাহিত্য চর্চার দিকগুলি তুলে ধরতে। 


কবিতা সিংহের কবিতায় দেখা যায়, নারীর স্বাধিকার সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি অঙ্গীকার। তিনি তাই লিখতে পারেন- 

একটি সতেরো বছরের মেয়ের পায়ের তলায়

লুটিয়ে পড়তে পারো না একবার একবারো

তাবৎ সলসার?

নারীকণ্ঠের এই দাপট অনুরণিত হলো একালের কৃষ্ণা বসু, মল্লিকা সেনগুপ্ত, তসলিমা নাসরিনের কবিতায়। মধ্যভাগে রইলেন বিজয়া মুখোপাধ্যায় বা দেবারতি মিত্রের মতো কবিরা। যাঁরা পুরুষতন্ত্রকে পদাঘাত করেননি, কিন্তু নারীর হৃদয়কে অকপটে ব্যক্ত করেছেন। 'নারী' নামক কবিতায় কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় লিখছেন-

গভীর রাত্রি        ঘুমোয় শিশু

নিদ্রাবিহীন         শুধুই নারী

স্তব্ধ পুরুষ          হৃদয় ধূসর

দোষ আমারি      দোষ আমারি।

সরাসরি দেহকামনার আর্তি ও জ্বালা প্রকাশ করেন এই সময়ের মহিলা কবিরা। কামে ও প্রেমে আর ভেদ রাখেন না তাঁরা। 


অন্যদিকে রাজলক্ষ্মীদেবীর কবিতা পড়তে পড়তে 'করাত' ও 'ভিখারিনী' শব্দের পৌনঃপুনিক ব্যবহার চোখে পড়ে। একদিকে যা যন্ত্রণার স্মারক, অন্যদিকে নিঃস্বতার ও আতুরতার প্রতীক। সব পেয়েও যেন পাওয়ায় তৃপ্তি নেই। সব দিয়েও যেন দেওয়া হলো না। সেই কবে তো কখনো হতাশায় শেষ হতে পারেন না। জীবন মন্থনজাত বিষ পান তাঁর নিয়তি; আর অমৃতটুকু রেখে যান সকলের জন্যে। জীবন, সংসার, জীবিকার ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়েও রাজলক্ষ্মী দেবী হৃদয়ের ভাষা ভোলেন না। প্রেমের ভিখারিণী যে রাণী হতে পারে তিনি জানেন। তাই 'ঘরকোণ থেকে বলছি' কবিতায় সুগভীর প্রত্যয়ে উচ্চারণ করেন এই সত্য-

সাহিত্যের মাঠে খুব ধুলো খেলাম, গোল করা হলো না।

তবু রেখে যাব অপটু অপর্যাপ্ত ভালোবাসা।। 


মধ্যযুগের দুই মহিলা কবি রামী এবং চন্দ্রাবতী। সম্ভবত প্রথম সচেতন কবিতার স্রষ্টা। নারীর গোপন বাসনা ও বেদনা, 'এমনকি প্রতিবাদও তাঁরাই ধ্বনিত করতে চেয়েছিলেন তাঁদের কাব্য সাধনায়। যদিও সে রচনা কখনো বৈষ্ণবীয়, কখনো রামায়ণের প্রচ্ছদে ঢাকা। কবি চন্দ্রাবতীর একটি লাইন খুব ভাবে নাড়া দেয় মনকে-" না কাঁদে না হাসে চন্দ্রা নাহি কহে বাণী। আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।।…" ব্যক্তি জীবনের প্রেম-অপ্রেম, বিরহ-মিলন কথা তাঁদের কবিতায় যে রূপলাভ করেছে, তা অস্বীকার করা যায় না। উনিশ শতকে এসে দেখি, মহিলা কবিরা আড়াল দিয়ে নয়, সরাসরি তাঁদের হৃদয়বেদনা ব্যক্ত করছেন। কখনো প্রেম, কখনো প্রিয় বিয়োগের শোক তাঁদের কবিতার ধারা উচ্ছ্বলিত করেছে। মহিলাদের এই আত্মপ্রকাশ সুগম, সহজ হয়েছিল এমন নয়। তবে আধুনিক কালে আরো নারীর কথা নারীর মুখে এবং কলমে প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চাশের কবি কবিতা সিংহের কবিতার মধ্যে দিয়ে। কবিতা সিংহের "অপমানের জন্য ফিরে আসি" কবিতাটিকে আমি মনে করি প্রতিবাদী, এও মনে করি কবিতাটি গর্জে ওঠা নারীকণ্ঠ। যেমন মনে হয় নারীর সংগ্রাম -

অপমানের জন্য বার বার ডাকেন 

ফিরে আসি

আমার অপমানের প্রয়োজন আছে!


ডাকেন মুঠোয় মরীচিকা রেখে

মুখে বলেন বন্ধুতার-বিভূতি-

আমার মরীচিকার প্রয়োজন আছে।


কবি নবনীতা দেবসেন- নবনীতা দেবসেন কী একজন নারীবাদী কবি? কোন কবিকে কী এভাবে একটা বিশেষ তকমায় বেঁধে ফেলা যায়? নারীর স্রোতস্বিনী জীবনের তরঙ্গভঙ্গ, প্রতিটি বাঁকের ভাঙন একজন নারীর কলমে উঠে আসাটাই তো স্বাভাবিক। বিশ্ব জুড়ে বিপরীত দুটি লিঙ্গের অর্থাৎ নারী-পুরুষের নানা সম্পর্কের মধ্যবর্তী টানাপোড়েনে আবর্তিত সমাজ। সেইখানে দাঁড়িয়ে বিংশ শতকে মনোবিদ ফ্রয়েড যৌনক্ষমতাকেই মানবচরিত্রের যে কোন আচরণ এবং অভিব্যক্তির জন্য দায়ী করেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের যে কোন সম্পর্কে আবেগ ও হৃদয়ানুভূতির তেমন কোন মূল্য থাকল না। প্রেম সম্পর্কে অনিবার্য হয়ে উঠল শরীর। ফ্রয়েড তার তত্ত্ব দিয়ে মানবিক সম্পর্কগুলোকে অনেকটাই যৌননির্ভর করে তুললেন। কিন্তু ফ্রয়েডের বিপ্রতীপে দাঁড়ালেন নারীচিন্তকগণ। তাঁরা মনে করলেন, এই মতবাদের মধ্যে রয়েছে আধিপত্যকারী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। তাঁরা 'সমাজে নারীর অবস্থান এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে দেখালেন নারী-স্বাধীনতাকামী যুক্তিপূর্ণ আবশ্যকতার দৃষ্টিতে।' সেখানে নারীর লিঙ্গপরিচিতি এবং যৌনপরিচিতি আলাদাভাবে গুরুত্ব পেল পরিবর্তিত সময়ে। নারী তাঁর যৌন-পরিচিতিকে সামনে রেখে প্রশ্ন তুললেন, নারীর যৌনযাপনে তার নিজের স্বাধীনতা কতটুকু? পরিবর্তিত বিশ্বে 'নারীর ব্যক্তিগত জীবন চার দেওয়ালের চৌহদ্দি এবং হৃদয়ানুরাগের সীমা লঙ্ঘন করে তা বৃহত্তর সামাজিক কাঠামো, রাজনীতি, লিঙ্গবৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য বিষয় হয়ে উঠল।' নারী তার নিজস্ব সূত্রে বুঝে নিতে চাইল আত্মগত সুখ-স্বাধীনতা। পুরুষের প্রতি একান্ত আনুগত্য, বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিক পরাধীনতা, স্বার্থশূন্য প্রেম প্রভৃতি একপেশে নারীসুলভ ধ্যানধারণাকে বর্জন করে নতুন করে জীবনযাপনের পথ করে নিতে চাইল। আর এই প্রেক্ষাপটেই বিশ্বের বহু কবির কলমে উঠে এল নারীমনের জটিল দোলাচলতা, সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এবং শৃঙ্খল ভেঙে উত্তরণের প্রচেষ্টা। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দ্বিগুণ সোচ্চার হল কাব্যভাষার স্বর। শারীরিক যৌনতার সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে নারী তার আত্মবিকাশ, আত্মপ্রকাশ আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যূথবদ্ধ হতে চাইল।' যখন প্রেমের মধ্যে নারী খুঁজে পেল তাঁর বিশ্বাসী বন্ধু প্রেমাস্পদকে, সমাজ যখন তাকে দিল 'আপন ভাগ্য জয় করিবার' মুক্ত আকাশ, যখন বিশ্ব মেনে নিল 'নারী তুমি অর্ধেক আকাশ', তখন প্রেমকে তাঁরা পূজ্য করলেন। পুরুষের পাশে দাঁড়ালেন তাঁর সহযোদ্ধা রূপে, রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ালেন তাঁর অনুগত নাগরিক রূপে, উজাড় করে দিতে চাইলেন নিজেদের শক্তি ও সামর্থ। তবে বর্তমান আলোচনা তাঁর 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' সংকলনকে ঘিরে। শুরুতেই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতো তাঁর কবিতার ভিতর থেকেই বুঝে নেওয়া যাক কবির মেজাজ-

সেই মেয়েটা,

মেয়ে ভীষণ জেদী আজকে ভাবে ঈগলপাখি হবো 

কালকে ভাবে সিন্ধুসারস হই-

শেষ অবধি জেদ রেখেছে ঠিক মেয়ে হয়েছে ঈষাণকোণের মেঘ, (মেঘ)


কবি কৃষ্ণ বসু- কবি কৃষ্ণা বসুর কবিতায় নারীবাদের সুতীব্র শব্দগুচ্ছ, রাগ, ঘৃণা এবং অসন্তোষের বিস্ফোরণ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। এই ধরণের একটা লেবেল সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর কবিতার সারা শরীরে। এতে আমাদের মতো পাঠকদের যতখানি সুবিধা হয় তার চেয়ে অসুবিধা হয় বেশি। কারণ এই তকমার বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার ভেতর অন্তর্ভেদী আলোকসম্পাত বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই ধরণের বিশ্লেষণ তাঁর কবিতার সামগ্রিক আয়তনকে চিহ্নিত করে না। বরং অনেক অনেক ক্ষেত্রে পাঠককে একটি বিশেষ কৌণিক বিন্দুর দিকে ঠেলে দেয়। কবি কৃষ্ণা বসুর কবিতা আসলে সময়ের নির্যাস। নিজের সমকালে হাঁটতে হাঁটতে তিনি চিরন্তন সময়ের প্রবণতাকেই লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর ভাষ্যে এবং উচ্চারণে। একটি সময়পর্বের তিনি উজ্জ্বল প্রতিনিধি। যাঁকে আশ্রয় করে গৌরবান্বিত হয়েছেন অনেকেই। যাঁকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে তৈরি হয়েছে এক নতুন ভাষাপথও। মানবিক দ্রোহ, অবক্ষয় আর জীবনসংঘাতের অন্তর্নিহিত বিষকে নিজের কণ্ঠে ধারণ করে শব্দময় করে তুলেছেন নিজস্ব স্বর। একদিকে তাঁর কবিতার ভাষা যেমন ঋজু স্পষ্ট ও বেগবান, অন্যদিকে সামাজিক এবং আত্মিক অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল বর্ণালীও শুদ্ধ বাস্তবতার আধেয় হিসেবে তিনি তুলে এনেছেন। ক্ষমতার কৃৎকৌশলে নির্যাতিত নারী শুধু নয়, মানবাত্মার নিষ্পেষণ এবং অপরিমেয় যন্ত্রণার আর্ত ধ্বনিগুচ্ছ সময়ের দগ্ধ নিষ্কর্ষসহ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কবিতার নামে কল্পকথা বা সুবিধাবাদের মনোরঞ্জক আরক তৈরি করে মায়াবী আলোর বিচ্ছুরণে মিথ্যাকে প্রগলভ করে তোলার যে সহজলভ্য পথ, তিনি এই পথ থেকে হাজার যোজন দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছেন বাস্তবের নুন তেল মশলার জীবন। দীপায়ন নির্ভর বিজ্ঞাপিত জীবনের বিপরীতে রিক্ত ধস্ত অন্তঃসারশূন্য প্রান্তিকায়িত জীবনবলয়ের হাহাকার থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন তাঁর কবিতার কথাবীজ। পণ্যায়িত সাহিত্যধারার বিপরীত স্রোতে তাঁর ভাবনায় অজস্র নির্যাতিত মুখের মিছিল। আপাততুচ্ছ বিষয়ের গভীরে সন্ধানীর মতো সাঁতার দিয়ে তা থেকে তুলে এনেছেন প্রবহমান জীবনের শাণিততর বিষয় ও বৈভব।

সাদা ভাত, জুঁই ফুল সাদা ভাত, ঘরে ঘরে

'ফুটে ওঠা ঝাঁ ঝাঁ

খিদের সময়... 

আহা ভাত, আহা 

লক্ষ্মী, কে তোমাকে অস্থির চঞ্চলা বলে? 

শিশুর হাসির মতো 

ঘরে ঘরে মাটির সানকিতে 

আর এনামেল পাত্র জুড়ে..." (অন্ন)


এ কি শুধু নারীর জীবন? ক্ষুধাবিষ্ট সমস্ত জীববিশ্বের অফুরান জীবনের কথকতা কি প্রতিফলিত হয়নি এই উচ্চারণের ভেতর? খিদের কষ্ট যেন গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দেওয়া আছে লাইনে লাইনে পঙক্তিতে পঙক্তিতে। একে কি নিছক কবিতা বলব আমরা? নাকি কবিতার সমস্ত আয়তনকে সরিয়ে, রুদ্ধতাকে অতিক্রম করে ক্লান্তিহীন যাপিত যন্ত্রণার পরিধি থেকে অগাধ অনন্ত জীবনের কথকতা? এই অদ্বিতীয় সংবেদনা এবং জাগ্রত চিন্তার পারিপার্শ্বিক থেকে মর্মচ্ছেদী হয়ে উঠেছে জীবন ও সমাজের সংকট। যা আমাদের ছ্যাঁকা দেয়, আরও বেশি সচেতন ও উদ্‌গ্রীব করে তোলে।

'এবং দরজা খুলে বেরোলেই সেই মিথ্যাগুলি, 

আমাদের সব সত্য মুহূর্তগুলিকে খেয়ে ফেলে'


কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত - মানবিকতার কথা অনেক হয়েছে, কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজের পরিবর্তন হয়নি, তাই মানবীকথার মধ্যে দিয়েই অনেক প্রশ্ন ও তর্কবিতর্ক ছুঁড়ে দিয়েছেন মল্লিকা। মার্কসীয় তত্ত্বে 'শ্রম' কথাটার বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হয়েছে। কিন্তু 'গৃহশ্রম' সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। নারী সারাজীবন গৃহশ্রমেই জীবন অতিবাহিত করে চলেছে। যদিও মার্কস 'লিঙ্গ' নির্ণয় করে তাঁর তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেননি। কিন্তু 'লিঙ্গ' অস্বীকারই বা করা যায় কী করে? 'অর্ধেক পৃথিবী' কাব্যের 'আপনি বলুন, মার্কস' কবিতায় লিঙ্গ বৈষম্যের এই ধারণাটি তুলেই মল্লিকা মার্কসকে প্রশ্ন করেছেন-

'ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল 

দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গম বোনা শুরু করেছিল 

আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন করেছিল শিশু 

সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে?


আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক, কে শ্রমিক নয় 

নতুন যন্ত্রের যারা মাসমাইনের কারিগর 

শুধু তারা শ্রম করে। 

শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল 

সেই শ্রমিক গৃহিণী 

প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে, খাবার বানায় 

হাড়ভাঙা খাটুনির শেষে রাত হলে 

ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে 

সেও কি শ্রমিক নয়।'


গৃহশ্রমে মজুরি হয় না, ঘরে ঘরে মেয়েরা বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেয়, কমরেড শুধু কাস্তে হাতুড়ি নিয়ে পৃথিবীতে শ্রেণীহীন শোষণহীন স্বর্গরাজ্য বানাবে-তাহলে মেয়েরা কি বিপ্লবীর সেবাদাসী হবে?' এই মারাত্মক প্রশ্নটি বাংলা কবিতায় মল্লিকাই একমাত্র সংযোজন করেছেন। প্রতিবাদই শুধু নয়, সমাজের কাছে উত্তরও চেয়েছেন, তর্কও তুলেছেন, বিশ্লেষণও করেছেন। নারী সত্তার জাগরণ তো এখানেই। তারও স্বাধীনভাবে বাঁচার ইচ্ছে আছে। উড়ার ইচ্ছে আছে, ভালোবাসার ইচ্ছে আছে-


দেখো আমিও মানুষ

আমিও তরুণী আজও 

আমারও জঙ্গল ভাল লাগে' (পাখির সঙ্গে)


নারীবাদী কবি হিসেবে নয়, মানবী কথার কবি হিসেবেই মল্লিকা সেনগুপ্ত বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর শব্দ প্রয়োগ, ভাষা প্রয়োগ, প্রশ্ন ও সাহসিকতা আগামী প্রজন্মের কবির কাছেও প্রেরণার বিষয় হিসেবে স্বীকৃত হবে। বিশ্লেষণ ও বিতর্ক চলতেই থাকবে। মল্লিকাও জানতেন- 'আমার কবিতা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে।'


কবি যশোধরা রায়চৌধুরী- কবিতা হৃদয়ের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আর তারই মধ্যে বড়ো সংগোপনে মিশে যায় সমাজ, চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি। ভারতীয় সমাজ শ্রেণী বিভক্ত সমাজ। শ্রেণী বিভাজন অবশ্য বিশ্বের সব সমাজেই আছে, কিন্তু ভারতীয় সমাজে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় বয়ে চলেছে। এই ভিন্ন ধারার শ্রেণী বিভাজন ভারতীয় সমাজকে ও দুমাত্র গতিহীনই করে রাখেনি, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিভাজনের বাইরে আরও একটি বিভাজনকে বড়ো বেশি দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। এই বিভাজন নারী পুরুষের বিভাজন। নারীর মানবসত্তাকে অপমান করার বিভাজন।


ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কবি কামিনী রায় এই নিয়ে কলম ধরেছেন। তাঁর কবিতায় নারীর যন্ত্রণা উঠে এসেছিল। এই ধারা ক্রমে অব্যাহত থাকল। বিংশ শতাব্দীর মধ্য সময় ধরে কবি কবিতা সিংহর কবিতায় এভাবেই শোনা গেল নারীর নিজস্ব কন্ঠস্বর। নব্বই শতকের কবি যশোধরা রায়চৌধুরী এঁদেরই উত্তরসূরী। বাহ্যিক পরিবর্তনের অভ্যন্তরে সেই গতিহীনতা আজও প্রকট হয়েছে অন্য রূপে। কবি যশোধরা সেই রূপকে তুলে আনলেন নতুন স্বরের বর্ণমালায়। তিনি লেখেন-


'ওহো শ্যাম্পু দেওয়া চুল, ওহো সূক্ষ্ম সাবানের কাচা 

রঙিন কাপড়, তুমি উড়ে উড়ে ঠ্যাং দেখিও না।


এ বড়ো অনন্য ঠ্যাং বড় বেশি মোহময় ঠ্যাং 

এ বড় নির্লোম বড় চেয়েচিন্তে ধার করা ঠ্যাং' -(বিজ্ঞাপন)

নারীর পণ্যরূপকে তুলে ধরেছেন কবি। নারী কী পোশাক পরবে, তা ছোটো হবে, না বড় হবে, এই সিদ্ধান্ত একান্ত নারীর। কিন্তু নারীর খোলামেলা শরীর যখন কর্পোরেট হাউসের দুনিয়ায় পণ্য বিক্রির মাধ্যম হয়ে ওঠে তখন আধুনিকতার আড়ালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরপরিচিত শরীরসর্বস্ব নারীর সেই 'পণ্য' রূপটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শরীরের কোন অংশ কতটা দেখাবে তা আর ব্যক্তি নারীর হাতে থাকে না। সে শুধুই তখন জিনিস বিক্রির মাধ্যম। এভাবেই বিজ্ঞাপনের আড়ালে নারীর মানবীসত্তা আহত হয়। পুরুষতন্ত্রের মন্ত্রমুগ্ধতার খোলস পরা নারী তা নিজেও বোঝে না।


কবি যশোধরা সমাজের অন্ধকার দিককে তুলে আনেন, যেখানে বিশ্বের দরবারে বৈপরীত্যের আঙিনায় ভারতীয় নারীর অবস্থানটি চিহ্নিত হয়। তাঁর 'শ্বেতাঙ্গিনীকে ১' কবিতার লাইনে লাইনে তাই বিদ্রুপ ফুটে ওঠে। কবি কঠিন আঘাতে জর্জরিত করেন ভারতীয় সমাজের অন্যায় বৈষম্যকে:


'সচরাচর আমরা এইভাবে ধর্ষিত হই না।

সচরাচর আমাদের ধর্ষণ হয় অনেক বীভৎস। 

আমাদের ধর্ষণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যায়। ধানক্ষেতে, জলে 

শুয়ে থাকতে থাকতে আমরা টের পাই,

বাস্তুসাপ চলে যাচ্ছে

নাসাপথে, চোখে ছিদ্র করে।'


যশোধরা রায়চৌধুরী কি নারীবাদী কবি? এ নিয়ে যেমন পাঠকের মনে প্রশ্ন আছে, তেমনি কবিও প্রশ্নচিহ্ন রেখেছেন। যদিও সাহিত্যে শিল্পে নারীবাদ পুরুষবাদ কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। তবুও একটা শ্রেণি যদিও কাল্পনিক ভাবনায় এই বিতর্ক জিইয়ে রাখতে চান। কবি যশোধরা রায়চৌধুরী অর্ধনারীশ্বর তত্ত্বে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন, প্রকৃতি-পুরুষ সম্পর্কই নতুন পৃথিবী নির্মাণ করে। যেমন মৌমাছি না থাকলে ফুল ফোটে না, পরাগ মিলন ঘটে না। তেমনি প্রকৃতিপুরুষ সম্পর্ক হোল শিল্পের সর্বোচ্চ রূপ। যা কবি শিল্প সৌন্দর্যে ঢেকে দিয়েছেন। যা তাঁকে কবি হিসেবে অন্যমাত্রা দিয়েছে। পারিবারিক জীবনের অভিঘাত ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বসংঘাতের ছবি তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে।


কবি তৃষ্ণা বসাক -এক কিশোরী। হাজার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেন সূর্যস্নানের মধ্য দিয়ে। হ্যাঁ সূর্যস্নান। কিন্তু কোথায় যেন কিভাবে ভেঙে গেল মনের মধ্যে জেগে থাকা স্বপ্নগুলো। সালটা ১৯৮৮ এর জানুয়ারী মাস। হঠাৎ পিতৃবিয়োগ। কিশোরীর স্বপ্ন ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেল। এমনকি কবিতার ভাষাও নতুনভাবে জন্ম নিল। না হার মানেননি। মেয়েটি এগিয়েছেন স্বপ্ন পূরণের দিকে। জীবনের জন্য জীবনসংগ্রামকে হাতিয়ার করে এগিয়েছেন। পিছু পা হননি কখনোই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.ই এবং এম.টেক পাশ করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণ বিভাগ অধ্যাপনায় যোগদান করেন। এই জার্নিটির যাত্রাপথ অনেক দূর্যোগ পূরণ কিন্তু জীবনকে বাজি রেখে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। পেয়েছেন সরকারি মুদ্রণ সংস্থায় প্রশাসনিক পদ। পালন করেছেন আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্পের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি এইসবগুলি। অর্থকারী বহু পেশা ছেড়ে মনোনিবেশ করেছেন সাহিত্যযাপনে। সাহিত্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি আর কেউ না, তিনি হলেন এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ কবি ও গল্পকার তৃষ্ণা বসাক। তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস কল্পবিজ্ঞান, মৈথিলী এবং অনুবাদকর্মে বৃহত্তর পাঠক সমাজের সামনে খুলে দিয়েছেন অনাস্বাদিত জগৎ। তাঁর কবিতাযাত্রার দীর্ঘতম পথে ধরা রইল বারবার জন্ম, মৃত্যু আর জন্মের স্ট্রেচমার্ক। ধরা থাকল আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা এক অনিকেত মানুষের চরণচিহ্ন। 


"যাঁর কবিতা আমার কাছে অনাবিষ্কৃত মহাদেশ" এই শব্দময় লাইনটি দিয়েই বইটি উৎসর্গ করেছেন কবি কথাকার অনিতা অগ্নিহোত্রীকে। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ আর একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে তাঁর সৃষ্টির মলাটটি উৎসর্গ করছেন। এ যেন গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি তৃষ্ণা বসাক সাহিত্য কে দেখছেন অনেক বড়ো ক্যানভাস থেকে। সাহিত্যের বিকাশ, প্রকাশ ও ভিত্তিস্তর নির্মাণের জন্য তিনি জীবন ও সৃষ্টি কে একবিন্দুতে স্থাপন করে একটা ধ্যানের মধ্যে দিয়ে লিখে চলেছেন। কবি তৃষ্ণা বসাক এর "যে কোথাও ফেরে না" কাব্যগ্রন্থের কথা বলছি। যে কোনো সৃষ্টিই একটা খরস্রোতা নদী। যার সৌন্দর্যে চক্ষু শীতল হয়। আত্মার আরাম হয়। সেই সৃষ্টিকে যথোপযুক্তভাবে আবিষ্কার করাই হলো সমালোচনা, আলোচক এবং পাঠকের একমাত্র কাজ। কথাগুলো এজন্যই লিখলাম কারণ, প্রকৃতি, সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রেম, সংস্কৃতি, যাপিতজীবন এবং ছন্দ যা কবিতার শরীরে হিরে মানিক জহরত এর মতো সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে- এত সব বিষয় নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থের আগমন। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পৃষ্ঠা ওল্টাতে হচ্ছে। কারণ, নব্বই দশকের কবি তৃষ্ণা বসাক এই কাব্য গ্রন্থে ত্রিশ বছরের লিখে যাওয়া কবিতার ডালি সাজিয়েছেন। যা বিস্মিত করেছে। কারণ কবিতাগুলো বাঁকে বাঁকে বাঁক বদল করেছে নিজের অবয়ব ও চিন্তা। তিনি আত্মসর্বস্ব ও স্মৃতিচারী হয়েছেন, অবচেতনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এসবের মধ্যে যখন কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে কাহিনির সূত্র, চিন্তার পারম্পর্য ও ব্যাকরণের চমৎকার শৃঙ্খলা মেনে চেতন- মনের সৃষ্টি ক্ষমতাই প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করতে যে বারবার মনে হয়েছে তিনি বাস্তব জগতের বিষয়কেই নিজের সত্তার সঙ্গে মিলিয়ে কবিতার পংক্তি সৃষ্টি করেছেন। বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশুদ্ধ স্মৃতি নিয়ে মানুষ বসবাস করতে পারেনা। যতই ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে অন্তর্জগতের মধ্যে বিলীন হবার চেষ্টা করা যাক না কেনো, আমাদের অজ্ঞাতেই প্রতিদিনের জাগ্রত জীবন স্মৃতির কাঠামো বদলে দেয়। নতুন অভিজ্ঞতা ও অতীত স্মৃতি প্রতিদিন কবিকে জীবন্ত ও সমৃদ্ধ করে তোলে।


খুব বাস্তব জীবনের চালচিত্র। ভাঙতে ভাঙতে সবাই গড়ে। যেমন নদীর এপাড় ভাঙে আর ওপাড় গড়ে। ঠিক তেমনি একটি কবিতা আমাদেরকে নাড়া দিবে। পিতৃহারা এক কিশোরী তাঁর যন্ত্রণার কথা ঘোরের মধ্যে লিখেছেন। যে ঘোর তাঁর সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। জন্ম মৃত্যু এ মানব জাতির সাথে জড়িয়ে আছে। কবি তাঁর পিতৃবিয়োগের পরের দিন "পিতৃতর্পণ" নামক একটি কবিতা লিখেন। বাবার জন্মদিনে সে একটি করে কবিতা উপহার দিতেন তাঁর বাবাকে। যা ছিল বাবার কাছে সব থেকে বড় পাওয়া। কিন্তু এ বছর তা হয়নি। মনে মনে লেখা হয়নি কবিতা। অভিমানে বাবা মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন "আচ্ছা দেখে নেব, আমাকে নিয়ে কবিতা লিখতেই হবে?" আসলে একে বলে আত্মবিশ্বাস। বাবার মৃত্যুর পরে যে কবিতাটি লেখা হয়েছিল তা আসলে ব্যক্তিগত কবিতা। কিন্তু এই ব্যক্তিগত কবিতাটি পাঠকদের মনে ছাপ ফেলেছে-

"লিখতেই হল,

তবু এই কবিতার বড় মৃদুস্বর,

'বাসাংসি জীর্ণানি' মন্ত্রে কবিতার কণ্ঠ ঢাকা পড়ে, 

কবিতা তো লিখছিই,

তবু বড় শক্তিহীন উরুভঙ্গ দুর্যোধন যেন,

সে কি মুছে ফেলতে পারে তোমার কপাল জুড়ে  চন্দনের ফোঁটা? 

সে কি সরাতে পারে তুলসীপাতা,ধূপ,দীপ?

সে কি নেভাতে পারে চিতার আগুন?"

কতটা ভালবাসা থাকলে এমন কথা লেখা যায় তা পাঠক কবিতাটির প্রতিটি লাইন পড়তে পড়তে অনুধাবন করতে পারবেন। একটি সম্পর্ক। যা কলমের ডগায় কিংবদন্তি হয়েছে। একজন পিতার চলে যাওয়া। একজন পিতার শূন্যতা কবি ব্যাখ্যা করেছেন। 

"বুকের মেঝেতে কারা যেন পেরেক পুঁতেছে,

রাস্তায় ছড়িয়ে গেছে অসংখ্য শোকমগ্ন খই,

দিয়েছে হরি ধ্বনি,

তবুও কি আত্মা ফিরে যায়?"

শেষবারের মতো যখন একটি মানুষের দেশ চলে যায় শ্মশান যাত্রার উদ্দেশ্যে তখন মনের মধ্যে থেকে যাওয়া প্রশ্নরা বারবার কাঁদিয়ে তোলে মনকে। আসলে দেহের বিনাশ আছে কিন্তু বিনাশ নেই আত্মার। বোধহয় পিতৃতর্পণ এমন ভাবেই প্রতিটি সন্তানকে করতে হয়।

"জন্মদিন থেমে যায়, মৃত্যুদিন বড় হয়ে ওঠে,

লেখো, লেখো, আমি প্রতিদিনই বেঁচে উঠি,

বেড়ে চলি,

ক্ষিতি-অপ-তেজ-ব্যোম-মরুত শরীর থেকে ধুলো ঝেড়ে

আবার নতুন ভ্রূণে যাই,

মাতৃগর্ভে খেলা করি…"

কবির মনের মধ্যে বাসা বাঁধা বেদনাগুলি কখন যেন গভীর রাতের কবিতা হয়ে উঠেছে। কানের কাছে অসহ্য সান্ত্বনাবাক্য, স্বার্থপর দার্শনিকতা। তবুও কিছু শব্দ পবিত্রতা বহন করে চলে। তখন মনের মধ্যে কে যেন বলে চলে "আত্মা তুমি পিতা হয়ে ওঠো"। 


১৯৮৯ এর একটি কবিতা আটকে দিয়েছিল পড়ার গতিকে। "নারীমুক্তি" কবিতাটিকে পুরুষ বিরোধী কবিতা বলা যেতে পারে। কবি গর্জে উঠেছিলেন তাঁর কবিতাযাপনে। এই পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে তাঁর কলম। এই প্রতিবাদ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। শোষিত বা শাসিত হচ্ছে নারীজাতি। কবি তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর পৌঁছে দিয়েছেন পাঠকের কাছে। আজ ২০২৪ এ দাঁড়িয়ে এই প্রতিবাদ গ্রহণ করেছেন বোধহয় নারীজাতি। প্রায় ৩৪ বছর আগে কবিতাটি লেখা হয়েছে। সেদিনের প্রতিবাদের সুর আজ নারীজাতির কাছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। 

পুরুষ ঠিক করেছে আমার পোশাকের রঙ,

আমার জুতোর মাপ,

বোরখায় কটি ছিদ্র শাস্ত্রসম্মত!

কিংবা কতটা দাহ্য নারীদেহ

ক'-লিটার কেরোসিনে হবে!

অথবা উর্বরাশক্তি, 

ফুলে ফলে তবেই তো নারী!

পুরুষ,  মহান পুরুষ 

সবই ঠিক করে রেখেছে আগে থেকে

আমি শুধু তার সুচিন্তিত মতামত নিয়ে

নারীমুক্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যাই,"

কবি তাঁর কবিতাযাপনে থাকতে গিয়ে নিজেকে একেবারে কবিতার মধ্যে আত্মনিমগ্ন করেছেন। আত্মজীবনী কবিকে তার ভাবনার জগতের পথ দেখায়। তাঁর দুঃখ কষ্ট বেদনা সমস্ত কিছুই ধরা পড়ে। তেমনি একটি কবিতা "আত্মজীবনীর একেকটা পাতা"। কবি লিখছেন -

"কবিতা যখন

আত্মজীবনীর একেকটা পাতা হয়ে যায়

তখন পুরো বইটা শেষ করতে ইচ্ছে করে না।"

কবিতার কথা যেন কবির কথা হয়ে উঠেছে। আসলে কবির কবিতায় বিচরণ বোধহয় এমনি। পাতার পর পাতা কবি সাদা কাগজের উপর লিখে চলেছেন কবিতার বর্ণমালা, কবিতার যন্ত্রণা, কবিতার চাওয়া পাওয়া। আসলে একজন কবি তাঁর মনের মধ্যে বিরাজমান ভাবনাগুলো মানবজাতির সাথে মিলে যায়। আসলে কবির ভাবনা তো এই মানবজাতির জন্যই। তার বোধহয় কবি অকপটে লিখতে পারেন-"আকাশে হেলান দিয়ে কবি এখানে ঘুমোচ্ছেন"।


আত্মসচেতনতা, মননের বৈচিত্র্য, নৈব্যক্তিকতার আদর্শ এবং ঐতিহ্যের দিকে মনোযোগ ছাড়াও প্রেম, ধর্ম, মৃত্যু, বিধাতা, কাল এসব বিষয় নিয়ে তৃষ্ণা বসাক সিরিজ কবিতার মধ্যে নতুন ভাবনার ডালি খুলেছেন। মূল্যবোধের নতুন এক দিক আমরা তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় খুঁজে পাই। সমুদ্রের গভীর তলদেশে ডুবুরি পৌঁছে গেলে বিস্মিত ও হতবাক হয়ে যায়। সমুদ্রের তলদেশ নতুন এক দুনিয়া। তেমনি তৃষ্ণা বসাকের শিল্পীসুলভ হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে শব্দের মণিমাণিক্যে। লাইব্রেরি হলো জ্ঞানের অকল্পনীয় অচিন্তনীয় বিশাল সাম্রাজ্য। লেখকদের চিন্তা শুয়ে থাকে তাকে তাকে। পৃষ্ঠা ওল্টালেই জেগে ওঠে এক একটা ঘুমন্ত ইতিহাস। স্বকীয় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একজন লেখক/ কবি মনের মাধুরী মিশিয়ে সমুদ্র মন্থন করে উপযুক্ত শব্দ সংগ্রহ করে সুসঙ্গত বাক্যের সুষমামণ্ডিত মালা গেঁথে রাখেন। তৃষ্ণা বসাকও তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে হৃদয়ের সাহচর্য ও কিছুটা অভিনবত্ব গরিমায় কবিতার কল্পতরুর জন্ম দিয়েছেন। কবি তৃষ্ণা বসাকের প্রতিভার রসায়নে আমরা উপলব্ধি করি; একটি সমাজের সকল প্রকার কলুষতা দূর করতে পারে লাইব্রেরি। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি সৃষ্টি করে মানুষ আত্মোপলব্ধির জন্য লাইব্রেরির দুয়ারে কড়া নেড়ে ভিতরে প্রবেশ করে যখন কোনো বইয়ের পৃষ্ঠায় ডুবে যাবে মগ্নতায়, ধ্যানে তখনই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে। তৃষ্ণা বসাক এই মেসেজ দিচ্ছেন তাঁর "লাইব্রেরি শার্ট খোলো " কাব্যগ্রন্থটির মাধ্যমে।

"জ্যােৎস্নাস্নাত স্নানঘর, হে পাঠক, স্নান করবে এসো,

বুদবুদ অক্ষরগুলি ভেসে যায়, জুড়োয় এস্প্রেসো…"


কবি তৃষ্ণা বসাকের কবিতা যাপনে ডুব থাকতে থাকতে খুঁজে পেয়েছি কবিতার স্পর্শকে, কবিতার সম্পর্ককে।  কাব্যের সেই বিশেষ অনুরণনকে অনুভব করেছি। যে কবি যত বেশি স্বতন্ত্র ও অভিনব তিনি তত বেশি নিঃসঙ্গ। আর নিঃসঙ্গতায় ধ্যানে মশগুল হওয়া যায়। সৃষ্টির অভিনবত্বের খোঁজ মেলে। কবি তৃষ্ণা বসাক কবিতায় নিজের স্বর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।


ওপার বাংলার কবি তহামিনা শিল্পী - তাঁর কবিতার মধ্যে উঠে আসে মানুষের কথা, মানুষের যন্ত্রণার কথা, মানুষের অসহায়তার কথা। তিনি বাংলাদেশের নারীদের জন্য লিখে চলেছেন তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি একজন নারী হয়ে নারীদের মর্মকথা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর কবিতার খাতায়-

দুইবেলা ভাত পাইনা,ঘাস চিবাইয়া খাই

ছাগল-পাগল যা খুশি কইতে পারেন তাই

বলদ-আবাল এসবতো শুনি হামেশাই

ভিক্ষা দিবেন? আত্মসম্মান বেঁচি না, যাই

কাজ দিবেন? লগে কিন্তু নায্য মুজুরী চাই

কিল,চড়,ঘুসি দুই চাইরটা ফ্রি পাবো নিশ্চই

ভাবছেন,মাকালফল; ঘটে বিদ্যাবুদ্ধি নাই 

পেশির জোড় দেখাইবেন,বলবো পলাই

দিন কিন্তু বদলাইছে, মনে রাইখেন মশাই

দ্বীন দরিদ্র আমরা সবাই একে অন্যের ভাই

দেনাপাওনা কড়ায়গণ্ডায় বুইঝা নিতে চাই।


মেদিনীপুরের নারীদের কবিতা- মেদিনীপুরকে বলা হয় কবিতার পীঠস্থান। এখানে যেভাবে সাহিত্যচর্চা করা হয় তা অন্য কোথায় তেমনটি দেখা যায় না। এখানে সাহিত্যচার্চার ক্ষেত্রে নারীরা অনেকখানি এগিয়ে। তাদের কলমে কখনো প্রেমের কথা, কখনো প্রতিবাদী সূর, কখনোবা সমাজের কথা। এমনি কয়েকজন কবির কথা কথা মনে এসে যায়-


কবি বেবি সাউ- বেবীর কবিতা অনেক বেশি মনসমীক্ষণবাদী। মনের গহীনে তার সাঁতার ও স্নান। অনায়াস তিনি স্পর্শ করেন মনের নিভৃত বারান্দা। চমকে উঠতে হয়। তিনি ভাবতে শেখান। প্রথাগত ভাবনা রূপ পাল্টে জন্ম নেয় নতুন ভাবনার। কবির কাজ তাই। তিনি পাল্টে দেন দৃষ্টিভঙ্গি। যুক্ত করেন নবতম বোধ। 'শীতবনে একা পড়ে আছি রাস্তায় জমিয়ে তুলি পৎঞ্চর দিন।' এই স্বর স্বতন্ত্র এবং অভিব্যক্তিময়। সুন্দর। কবিতা পড়ার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ব্যস্ত জীবনে যে অনুভূতিগুলি কোনও এক বেগবান নদীর মতো শুকিয়ে গেছে, স্রোত কমে জমেছে সাংসারিক মেদ, সেই মন্থর ধারাকে উজ্জীবিত করে কবিতা। আর যদি সেই কবিতা হয় অনুভবের, হয় শীতের সকালে শুকনো পাতা জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার মতো অকৃত্রিম, অবশ্যই সঞ্চারিত করে অন্য এক অনুভব। আরও নগ্ন হতে হয়। আরও মনোযোগী হতে হয় পাঠে এবং অবশ্যই অনুভবে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা অনিবার্য এসেই যায়।


আলোচনার প্রয়োজন পড়ে। বেবীর কবিতায় কোথাও কোনও আরোপিত স্মার্টনেস চোখে পড়েনি। মনে হয়নি কবিতাগুলি রচিত নয় নির্মিত। এই দুটি শব্দ নিঃসন্দেহে বিতর্কের জন্ম দেবে। প্রশ্ন আসবে কবিতা রচিত হয়, নাকি নির্মিত হয়। আসলে কবিতা সম্বন্ধে সব তত্ত্বই স্ববিরোধী এবং পরিবর্তনশীল। এক একজন সাহসী কিংবা শক্তিশালী কবি এক একটি ধারা উপহার দেন। সূচনা করেন অন্য ধারার লেখনরীতি। উপস্থাপন ভঙ্গি। শব্দ এবং উপমার ব্যবহার। মৌলিক এই লিখনরীতি একটি ধারার সূচনা করে। আবার অনেক সময় দেখা যায় তীক্ষ্ণ সূচকের মতো শব্দের ব্যবহার বিষয়ের ব্যঞ্জনা। কবিতা হয়ে উঠছে বক্তব্যের মতো ঋজু এবং লক্ষ্যে অবিচল। এই ধরনের স্মার্টনেস বেবীর কবিতায় নেই। বরং বলা যায় তার কবিতা অপরাহ্নের আলোর মতো ছড়িয়ে যেতে চাইছে সমগ্র ভুবনে। ছুঁতে চাইছে আমাদের অক্ষিপল্লব, ওষ্ঠ এবং হৃদিস্থল। আমাদের মর্মলোক।

'দিতে তো পারিনি কিছু। 

শুধু বলে গেছি 'থেকে যাও'


কবি অর্থিতা মণ্ডল - কবি অর্থিতা মণ্ডল। এই সময়ের একজন উদিয়মান কবি। তার কবিতার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই সমাজ গঠনের ধারা। খুঁজে পাই প্রতিবাদী সূর। আবার তার কবিতার মধ্যে প্রবেশ করার পর এক নতুন আত্মউপলব্ধির সন্ধান পাওয়া যায়-

আয়ু রেখে আসি বুড়িমার থানে আর কিছু নয়,

ছলন দিয়েছে যারা কামনা ঘিরে ঘিরে লাল সুতোর ভিড়

সে সব দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে রাত হলে নেমে আসেন অলৌকিক মায়া

এদিকে মৃতদেহ স্তূপ জমা হয়, কাঁটা ছেঁড়া লাশ-


বহুবার পুড়িয়েছি খোলোস। ভেসে গেছে শেষ নভিবিন্দু জলে।

আমাদের শান্ত গৃহস্থালী

আহা চাঁদ! আহা মায়া! আয়ু পাক অনাগত ভ্রূণ

আমি মনে করি কবিতা এমনি হওয়া উচিত। কবিতা তার নিজ মহিমায় রচিত হবে। কবিতা আর কবি তার নিজের ভাষা নিজের উপলব্ধি সমাজের কাছে উপহার দেবে। তেমনি একজন কবি অর্থিতা মণ্ডল। 


কবি অর্পিতা কুণ্ডু- বোধহয় নিজেকে আড়ালে রেখেই কবিতা লিখতে ভালোবাসেন কবি অর্পিতা কুণ্ডু। তাঁর কবিতার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই সাবলীল ধারা। যে ধারার উপর নির্ভর করে তাঁর সাহিত্যযাপন। 


তোমার ধর্ষণ থেকে মুখ এই ঘুরিয়ে নিয়েছি 

প্রভু, তোমার বিষাদে

আলো জ্বালি জবুথবু শীতের আর্তিতে

মরা গাঙে ঢেউ এলে ফিরাই নিহত শুখা তটে

কিঞ্চিৎ বাতাসে ঠোঁট রাখি…

গুনগুন যে গানের দিন তাকে তুলে রাখা ছিল,

পেড়ে আনি, রোদে দিই, আগুনের আঁচে

আলো নেই, তেতে পুড়ে দিন-রাত 

আমসি হয়েছে বেশ—

বয়ামে বয়ামে ভরে, ঢালি

ঝাঁঝালো সোনালি খাঁটি সরিষার তেল

আমি মনে করি এটি হলো কবির নীরব প্রতিবাদ। প্রতিটি লাইনের মধ্যে প্রতিবাদী সুর। একবার কান পেতে শুনন শুনতে পাবেন এক গভীর আত্মনাত। কতটা গভীরে প্রবেশ করলে এ কথা লেখা যায় তার প্রকাশ হলো "তোমার ধর্ষণ থেকে মুখ এই ঘুরিয়ে নিয়েছি / প্রভূ, তোমার বিষাদে"। এ সমাজ প্রভূ। আমরা তার অধিনস্থ মানব জাতি। আমরা বোবা। আমরা দেখি। আমরা প্রতিবাদী হইনা। কিন্তু কবি তার কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়েছেন গর্জে ওঠার সুর।


কবি খুকু ভূঞ্যা- জীবনের কথা লিখে চলেছেন কবি খুকু ভূঞ্যা। হ্যাঁ জীবনের কথা। আসল কথা হলো জীবন মানে আমি আমরা, তুমি তোমরা। কবি অকপটে সেই কাজ করে চলেছেন। গ্রাম বাংলার ধানক্ষেত, নদীনালা তার আত্মজ। তার প্রাণের স্পন্দন। তিনি তার জীবনকে কবিতাযাপনের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। কবি তার কবিতার মধ্যে কখনো কৃষক গৃহবধূর কথা বলেছেন, কখনো ভালোবাসার কথা লিখতে গিয়ে অভুক্ত মেয়েটি কথা উঠে এসেছে তার কলমে। অতি সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে কবিতা তার পরিমণ্ডলকে দেখেছেন। তার লেখার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই জীবনসংগ্রামের কথা। 


আমাকে কখনো কি তুমি আরোগ্যের স্বপ্ন দেখিয়েছ

ছিঁড়ে খাওয়া লাশ দেখিয়ে বলেছ এই তোমার মা এই তোমার বোন প্রিয় আত্মজা

আমিও দুর্গন্ধ মাপতে মাপতে ভুলে গেছি বীজমন্ত্র

এই যে এত কালো ধুতুরা দেখছো, না ফেরা মেয়েটির আশাতুর রাত

আঁচড় কাটা নাভি বুকের আর্তনাদে রক্ত হয়ে গেছে অশ্রু


তুমি কি নতুন কোনো ভোরের কথা লিখছ শ্রী

আমার জ্বর পোড়া ঠোঁটের উপর পড়ে আছে মৃত পৃথিবীর ছাই

সিগারেট গন্ধ পেলে মনে হয় আমার শবদেহ নিয়ে তুমি শোক পালন করছ, 

আসন্ন কুরুক্ষেত্রে

এ এক নীরব প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। যা সমাজের নারীদের মনের কথা। আসলে নারীপুরুষ বলে কিছু হয় না। এই বিভাজন তোমার আমার। আমরা আমাদের স্বার্থে জন্য এই বিভেদ রেখা সৃষ্টি করেছি। কবি তার সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে তার কবিতাচর্চাকে সাবলীলভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করে চলেছেন।


শেষের কথা - একেবারে শেষে এসে যে মানুষটি কথা না বললে এই আলোচনার কোনো স্বার্থকতা থাকবে না, তিনি হলেন কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়। আমাদের সঙ্ঘ ভেঙে গেছে। আখড়াগুলি ভাঙো ভাঙো। আমাদের যাপনের ভেতরে লবণের স্বাদ ঠিক তত খর নয়। আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ি কিংবা পাখির উড়ান দেখার দিন ফেলে এসেছি। আমরা মনে করতে শিখে গেছি সমস্ত শূন্যের ভেতরে বিস্মিত নয় বরং বিস্মৃত হবার গলিপথ রয়েছে। আমরা ভাবতে শিখেছি ঝনঝন না করলে সেটা শিকল নয়। আমরা লিখতে শিখে গেছি। ফলে আমরা লিখতে পারি। বলতে শিখে গেছি। ফলে আমরা বলতে পারি। কিন্তু কী লিখি, আর কেনই বা লিখি সেটা আর জানা হয়ে ওঠেনি। আমাদের সবকিছুই এখন-এমনি এমনি। আমাদের বলা-এমনি এমনিই। আমাদের এই 'এমনি এমনি' জীবনের মাঝে কখনো কখনো ফুটে ওঠে কয়েকটি পঙক্তি। যাদের দিকে তাকালে মনে হয় শব্দের আয়ু চিরকাল শব্দাতীত। কথার আয়ু বাক্যাতীত। আর শূন্যের ভেতরে জেগে থাকে বিস্ময়ের বীজতলা। আর এইখানেই থাকে জীবনের গাঢ়তম ভোর। এইখানেই প্রার্থনা জেগে ওঠে। এইখানেই ঘুমের গুহ্যতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার আকুতি জাগে। যেন ঠিক এখানেই লেখা হল-

আমি মৃত্যুতে আছি

আমাকে ডাকো

  আকাশে

ঐশ্বর্যে

জীবনে।

আমি গুহাহিত 

আমাকে নাও

কথা থেকে কবিতায় বা কবিতা থেকে কথায়-দুদিকেই যাওয়ার পথ তিনি রেখেছেন তাঁর লেখায়। প্রেম, অসম্মান, ক্ষোভ, ক্ষত, সবই এসেছে, এসেছে তাঁর নিজের মতো করে। তিনি চারপাশের মধ্য থেকেই সবকিছু তুলে এনেছেন ঠিকই, সেসব তুলে আনার পরেও সচেতন থেকেছেন। তীক্ষ্ণ নজরে দেখেছেন যা তুলে আনা হল তা রাখার প্রয়োজন আছে কি না। তিনি শব্দ ব্যবহারে সচেতন থেকেছেন। এক প্রবল পরিমিতি বোধের দেখা পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। তিনি শব্দের আগ্রাসনে যাননি। বরং গেছেন শব্দ-রোপনে। জানতেন তাঁর পরিসর। সেটিকেই নিজস্ব করে তুলেছিলেন। সেখানে হৃদয় আর মগজ- দুইয়ের-ই ব্যবহার করেছেন। তাঁর কবিতাকে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে ফেলে দেওয়া যায় না।


আজকের ভোর মলিন। আজকের সন্ধ্যা 

ধোঁয়াটে। দেখা যায় না জলে প্রতিচ্ছবি, সকালের সূর্য 

আর সন্ধ্যার তারামণ্ডল। 

এ বিভ্রান্ত মানুষজীবনে আজ নেই শুদ্ধতার ভাষা, স্বচ্ছ দিন আশ্বাসভরা হাওয়া। 

মরতে মরতে বলে যেতে চাই,

বন্ধ হোক লজ্জা-রক্তপাত,

আবন্ধ, অব্যর্থ হোক মানুষজীবন।


একি খুব বেশি চাওয়া হল?


যেমন ধূলোপায়ের একটা নিজস্ব জার্নি থাকে, মেঘের থাকে, পাতার থাকে, শস্যের থাকে, তেমনই বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রথম পংক্তি থেকে শেষ পংক্তি পর্যন্ত একটা জার্নি থাকে। কবির, কবিতার ও পাঠকের অনিবার্য জার্নি।

............................


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

প্রচ্ছদ ভাবনা - ইন্টারনেট

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...