রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৩৭
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু
মহাশ্বেতা দাস
"ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।"
ঠাকুর পরিবারের ধুমধাম করে জন্মদিন পালনের রীতি প্রায় ছিল না বললেই চলে। ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে মেজ বৌঠান অর্থাৎ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বিলেত থেকে ফিরে এসে তাঁর কন্যা ইন্দিরার জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করলেন। ইন্দিরার প্রিয় ' রবিকা' আদরের বিবি'কে একটি সুন্দর পিয়ানোর মত কাঠের বাক্স (দোয়াত দানি) এবং "জন্মতিথির উপহার" নামে একটি কবিতা লিখে উপহার দিলেন ভাইঝির ত্রয়োদশ বর্ষীয় জন্মদিনে।
" হাসিকান্না হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে…"
১৮৮৬ সালের ৭ই মে ভাগ্নী "সল্লি" ঘটিয়ে ফেললেন আর একটি মনোমুগ্ধকর ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী ওরফে সল্লি রবিমামা কে ডাকতেন "রইমা" বলে। রবি তখন পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে মেজদা ও মেজ বৌঠানের সাথেই দিন যাপন করছেন। বিপত্নীক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তখন ঐ বাড়িতেই থাকেন। সেদিন সল্লি খুব ভোরে উঠে দাদা জ্যোৎস্নানাথ কে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে। বাড়ি থেকে নিজের হাতে বকুল ফুলের মালা গেঁথে এনেছিলেন। পথে কিনে নিলেন বেলি ফুলের মালা। এছাড়াও আছে ধুতি চাদর এবং ইংরেজি কবিতার বই "The poems of Heine" । সোজা চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথের ঘরে। নৈবেদ্য সাজিয়ে প্রনাম করলেন "রইমা" কে। ভাগ্নী সল্লি'র মাধ্যমে শুরু হলেও অন্যান্য ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে… কারও উৎসাহে কমতি নেই। সারা বাড়িতে সাড়া পড়ে গেল "আজ রবি'র জম্মদিন" । অভিভূত রবির মনে তখন হয়তবা "নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু" র স্পর্শ দোলা দিয়ে যাচ্ছে!
এরপরও বহুবার পারিবারিক বন্ধনের ভিতরে পালিত হয়েছে কবির জম্মদিন। ঘটে গেছে রবির জীবনে ভালো- মন্দ কত না ঘটন-অঘটন। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু, তারপর একে একে রেনুকা, শমীন্দ্রনাথ…. চলে গেলেন পরপারে। পুত্র রথীন্দ্রনাথও সংসার পেতেছেন প্রতিমা দেবীর সাথে। কবি ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন বিশ্বভারতী নিয়ে…. লেখালেখি তো চলছেই। স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের মায়া কাটিয়ে কবির তখন বিশ্বের দরবারে ক্রমশ আবির্ভূত হওয়ার পালা।
১৯১০ সালের মে মাসে কবি কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন। তখনও তিনি জানতেন না কী অপেক্ষা করছে ৭ই মে সকালে! কবির পঞ্চাশতম জন্মদিনে আশ্রমবাসিরা (ছাত্র এবং অধ্যাপক) রবীন্দ্রনাথকে আগে থেকে না জানিয়ে মহাসমারোহে জন্মদিন পালন করলেন। উৎসবে কবি ভাষণে বললেন -
"মানুষের মধ্যে দ্বিজত্ব আছে। মানুষ একবার জন্মায় গর্ভের মধ্যে আবার জন্মায় মুক্ত পৃথিবীতে। তেমনই একদিকে মানুষের জন্ম আপনাকে নিয়ে, আর এক জন্ম সকলকে নিয়ে। একদিন আমি আমার পিতা মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছিলুম… সেখানকার সুখদুঃখ ও স্নেহ প্রেমের পরিবেষ্টন থেকে আজ জীবনের নূতন ক্ষেত্রে জন্মলাভ করেছি। পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়ে তবে মানুষের জন্মের সমাপ্তি, তেমনই স্বার্থের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে মঙ্গলের মধ্যে উত্তীর্ণ হওয়া মনুষত্বের সমাপ্তি। "
কবি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকারের স্ত্রী নির্ঝরিণী সরকারকে চিঠিতে লিখে জানালেন তাঁর সেই খুশির কথা। কবি চিঠি তে লিখলেন…..
”আজ মনে হল নব জন্ম লাভ করেছি। এখানে যারা আমার কাছে এসেছে আমাকে কাছে পেয়েছে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার কোন সম্বন্ধ নেই । এই আমার শান্তিনিকেতন আশ্রমের জীবন – এই আমার মঙ্গললোকে নূতন জন্ম লাভ।”
এরপর তাঁর মুকুটে এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার (সাহিত্য) লাভের পালক যোগ হয়েছে …….তখন তিনি বিশ্বকবি। স্বভাবতই বিশ্ব খ্যাত কবির জন্মদিন পালনের ঢেউ সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আছড়ে পড়ল দেশ-বিদেশের মাটিতে।
রবীন্দ্রনাথই বোধয় একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের জন্মদিন নিয়ে কবিতা, গান রচনা করেছেন। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ কালিম্পংয়ের গৌরীপুর ভবনে থাকা কালীন কবি "জন্মদিন" কবিতা রচনা করেন। কবিতাটি পরে "সেঁজুতি" কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। "নাট্য শেষের দীপের মালা সাঙ্গ" হওয়ার দুই বছর দুই মাস বাইশ দিন আগে কালিম্পংয়ের জন্মদিনে কবি চেতনায় জাগ্রত হয়েছিল -
"আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে
মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে কী জানি
পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি
সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে; নবসূত্রে পড়ে আজি গাঁথা
নব জন্মদিন। জন্মোৎসবে এই-যে আসন পাতা
হেথা আমি যাত্রী শুধু, অপেক্ষা করিব, লব টিকা
মৃত্যুর দক্ষিণ হস্ত হতে, নূতন অরুণলিখা
যবে দিবে যাত্রার ইঙ্গিত।
আজ আসিয়াছে কাছে জন্মদিন মৃত্যুদিন, একাসনে দোঁহে বসিয়াছে,দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবনপ্রান্তে মম
রজনীর চন্দ্র আর প্রত্যুষের শুকতারাসম--
এক মন্ত্রে দোঁহে অভ্যর্থনা।"
গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজার মতোই আজও তাঁর জন্মদিনে পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানমালার অপরিহার্য গান ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার’। গানটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ জন্মদিন উৎসবের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৯৪১সাল/১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৩ শে বৈশাখ রচনা করেন। উল্লেখ্য ১৩৪৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ গানটি প্রথম গীত হয়। গানটিতে সুর দিয়েছিলেন শান্তিময় ঘোষ।
………………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ - অভিষেক নন্দী
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment