পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্ধ সিনেমাহলের কথা ৫
মহামায়া টকিজ - কল্মীজোড়
শ্রীজিৎ জানা
এক যে ছিলেন কবি। কবিযাল নহে। ঢোল কাঁসির বোল তুলে তরজা গানের কবি নয়। পদ্য লেখার কবি। ভাবছেন সিনেমাহলের সাথে 'কাঁধেতে ছোলানো ব্যাগ' ভাবুক কবির সম্পর্ক কীভাবে? সম্পর্ক পাতালেই হয়।তবে তিনি খানিকটা কফি হাউস গানের অমলের মতো কবি। একটা কবিতা তার ছাপা হয়নি কোনদিন। কিন্তু কবিতা অন্ত প্রাণ ছিল তাঁর। তবে এমন কবিতা প্রীতির কারণ ছিল সঙ্গত। সেইকথা একটুখানি বলা খুব দরকার। ঘাটাল মহকুমা শুধু নয়, অভিভক্ত মেদিনীপুর নয়, সারা বাংলার অত্যন্ত প্রতিভাবান কবি ছিলেন কবি দিবাকর ঘোষ। বাড়ি দাসপুর থানার নন্দনপুর গ্রাম। পেশায় দিবাকর ঘোষ ছিলেন নন্দনপুর স্কুলের মাস্টারমশাই। আর ওই স্কুলের একদা মেধাবী ছাত্র হলেন পঞ্চানন পড়িয়া। পল্লিবাংলার কবি দিবাকর ঘোষের সান্নিধ্য্ তাকে কবিতা লেখার প্রেরণা জোগায়। লুকিয়ে খাতার পাতা ভরাতেন কবিতার পর কবিতায়। একদিকে পড়াশুনা অন্যদিকে গোপনে কাব্যচর্চা দুই চলতে থাকে। কিন্তু ওই বয়সে তার অধ্যাত্ম প্রীতি বাবা-মা সহজ মনে নিলেন না। স্কুল ফাইনাল চলাকালীন ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন। মনে দুঃখে, রাগে সব ছেড়েছুড়ে মন দিলেন অর্থ রোজগারে।
সেইসময় টালিভাটায় একটি অস্থায়ী সিনেমাহল গড়েন তমলুক নিবাসী পরিতোষ দাস। পূর্বে 'কমলা' নামের সেই সিনেমাহল নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। উক্ত সিনেমাহলে কাজ নেন পঞ্চানন বাবু। কিন্তু কয়েক বছর চলার পর 'কমলা' সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। তখন বন্ধ সিনেমাহলের কর্মচারীদের অনুরোধে পঞ্চানন বাবু শেয়ারে একটি সিনেমাহল চালু করেন। বর্তমানে টালিভাটা হাটের পশ্চিম দিকে নেতাজী সংঘের সন্নিকটে ( খাড় রাধাকৃষ্ণপুর মৌজ) ছিলে সেই সিনেমাহলের অবস্থান। সালটা আনুমানিক ১৯৫৯—৬০। দুর্ভাগ্যের বিষয় এক বছর চলার পরই সেই সিনেমাঘরেও তালা পড়ে যায়। অথচ পঞ্চানন বাবুর মাথা থেকে কিছুতেই সরছিল না সিনেমাহল তৈরীর ভাবনা। অসম্ভব জেদ নিয়ে কাঁসাই নদীর তীরে কল্মীজোড় মৌজায় লিজে নিলেন জমি। বর্তমান কল্মীজোড় প্রাইমারী স্কুল সংলগ্ন স্থানে গড়ে তুললেন তাঁর স্বপ্নের সিনেমাহল 'মহামায়া'। ধর্মপ্রাণ বঙ্কিম বাবু দেবী মহামায়ার নামে তার সিনেমাহলের নাম রাখেন।স্থাপনকাল ১৯৬৩।
চলুন মহামায়া সিনেমাহলে একবার ঢুঁ মেরে আসি। কিভাবে যাবেন? এক্কেবারে সোজা পথ। পাঁশকুড়ার দিক থেকে আসুন অথবা ঘাটালের দিক থেকে, নেমে পড়ুন বেলতলা বাসস্টপে। সেখান থেকে পশ্চিমে যে পিচ রাস্তা চলে গেছে কাঁসাই নদী বাঁধের দিক,সেই রাস্তা বরাবর ২/৩ কিলোমিটার গেলেই মহমায়া টকিজের খোঁজ মিলবে। আত্মভোলা আর ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন পঞ্চানন প্যোড়া। সেইসময় প্রাইমারী ও পোস্ট অফিসের চাকুরী এলেও কম বেতনের জন্য করলেন না। তারচেয়ে ঝুঁকে পড়লেন সিনেমাহল ব্যবসায়। প্রথমদিকে মহামায়া টকিজের প্রোজেক্টর মেশিন সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ছিল ভাড়ার। পরে যখন কল্মীজোড় থেকে স্থানান্তর করলেন খাড় রাধাকৃষ্ণপুরে তখন সবকিছু নিজে করলেন। ইতিমধ্যে পঞ্চানন বাবুর ভাই বঙ্কিম প্যোড়া বিয়ে করেন খড়্গপুর থানার সুলতানপুর গ্রামে চৌধুরী পরিবারে। সেই চৌধুরী পরিবারের ছিল রাধেশ্যাম চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত 'শ্যামসুন্দর টকিজ'। কিন্তু তখন সিনেমাহলটি বন্ধই ছিল। সেই বন্ধ শ্যামসুন্দর টকিজের মেশিনপত্র নিয়ে আসাহল মহামায়া টকিজের জন্য। কিছু নতুন মেশিনও এল কোলকাতা থেকে। এমনকি মহামায়া সিনেমাহলের জন্য কাঠের চেয়ার ও সিলিংফ্যান কেনা হয় কলকাতার 'ছায়ারানী' সিনেমাহল থেকে।
প্রথমদিকে মহামায়া সিনেমাহল ছিল মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া। পরে তিনদিক পাকার দেয়াল গেঁথে মাথায় অ্যাসবেসটস চাপানো হয়। ছাদে দেওয়া হয় কাঠবোর্ড। একেবারে বসতবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিল এই সিনেমাহল। সিনেমাহলে দর্শকাসনে ছিল চারটি রো। ফার্স্টক্লাসে ১০০টি গদি দেওয়া সিট,সেকেন্ডক্লাসে অ্যাঙ্গেল ১০০ সিট,থার্ডক্লাসে কাঠের ১৫০ সিট আর একেবারে সামনে ছিল ঢালাই সিট ১৫০ টি। শুধু তাই নয় দুদিকের দেয়ালে তক্তা পিটে ব্যালকনি বানানো হয়। বহুক্ষেত্রে সেখানেও দর্শক বসে সিনেমা দেখতেন।
একসময় রমরমিয়ে চলত মহামায়া সিনেমাহল। ভিড় উপচে পড়ত। বিশেষ করে ধর্মীয় সিনেমাগুলোতে। 'মহাতীর্থ কালীঘাট' 'বেহুলা লখীন্নদর','যমলায় জীবন্ত মানুষ','স্বয়ংসিদ্ধা', 'সূর্যতপা','হারানো সুর' প্রভৃতি ছায়াছবি মহামায়া প্রেক্ষাগৃহে শো হাউসফুল চলে। তখন মূলত ৩ এবং ৬ টার শো হত। কল্মীজোড়ের গুণধর বাগ পিঠে চটের থলিতে পোস্টার সাঁটিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে নিত। আর হাতে চোঙা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করে বেড়াত। পরে অবশ্য মাইকে প্রচার চালু হয়। শুরুর দিকে ফোর্থ ক্লাসের টিকিটের মূল্য ছিল ১৯ পয়সা,সেকেন্ড ও থার্ড স্টলের মূল্য ৪০ ও ৫০ পয়সা। ফার্স্ট ক্লাস ১ টাকা এবং ব্যালকনির টিকিট মূল্য ১.৫০ টাকা।
মহামায়া টকিজে কর্মচারী নেহাত কম ছিল না। গেট কিপার ছিল ছ'জন। টিকিট কাউন্টারে চারজন,বুকিং ক্লার্ক চারজন,মেশিনারি চিফ একজন,হেল্পার দু'জন। চিফ অপারেটর ছিলেন বিনয় দে,পরে গোঁসাইবেড় গ্রাম থেকে আসেন নারায়ণ মাইতি।
টালিভাটা এলাকায় সিনেমাহল নিয়ে ছড়াটি প্রায় লোকের মুখে মুখে ঘুরত। মহামায়া সিনেমাহল নিয়েও ওই এক ছড়া-ই শোনা যেত সবার মুখে, " ঢকর ঢকর ডায়নামা / পঞ্চু পোড়ার সিনেমা / চোদ্দ বার ফিলিম কাটে / পঞ্চু পোড়ার পিছন ফাটে "। মহামায়া সিনেমাহল প্রথম দিকে চলত জেনারেটরে। মাঝে মাঝেই জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে সিনেমা দেখার ব্যাঘাত ঘটত। হলকর্মী পর্দার সামনে হ্যাজাক ধরে দাঁড়াত। মহামায়া সিনেমাহলের মালিক পরিবারের বঙ্কিম প্যোড়া জানালেন, " এমনও অনেকবার হয়েছে বিকল যন্ত্রকে সারিয়ে সচল করা সেদিন সম্ভব হয়নি। দর্শকদের টাকা ফিরত দিতে হয়েছে। একটাই সৌভাগ্যের বিষয় কোনরকম উত্তেজনা করেনি দর্শকরা"। একইসাথে আরো জানান–" আমাদের হলে প্রথম দিকটায় এত ভিড় হত যে পর্দার সামনে চট বিছিয়ে বসে পর্যন্ত সিনেমা দেখেছে সিনেমাপ্রেমীরা। পৌরাণিক সিনেমায় এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, দেবদেবীর আবির্ভাব দৃশ্যে তাঁর উদ্দেশ্যে পর্দার দিকে পয়সা ছুঁড়ে দিয়েছেন বয়স্ক মানুষজন। শো শেষে সুইপারের ভাগ্যে জুটত সেই প্রণামী"। কল্মীজোড়ে গ্রামের পার্শ্ববর্তী কাদিলপুর গ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষক অশোক গোস্বামী জানালেন মহামায়া সিনেমাহলকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথা, " আমরা আসতাম নদীর ওপার থেকে। সঙ্গে থাকত আমার দুই বন্ধু অরূপ আর অনুপ। ছোটবেলায় বড়দের চোখ এড়িয়ে আসতাম। সিনেমাহলের গেটের কাছে উঁকিঝুঁকি মারতাম। কিন্তু টিকিটের পয়সা থাকত না বলে ঢুকে সিনেমা দেখা হত না। তবে ওই যে হলের কাছে আসা বাইর থেকে সিনেমার ডায়লগ শোনা তাতেই আনন্দ হত প্রচুর। একটু বড় হয়ে যখন এলাম তখন বেশি আকর্ষণ ছিল দামী সিট গুলো কেমন দেখা। আমরা কম দামের টিকিট কাটতাম। বিরতিতে বাইরে বেরিয়ে দশ পয়সায় আইসক্রিম খেতাম। আর বেশি ভাল লাগত বিরতির মাঝে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন। একটা এখনো মনে আছে — চাষী ভাই ফসলে মাজরা পোকা হানা দিতে পারে। বায়ার -এর মেটাসিড-৫০ ব্যবহার করুন"। ঘাটাল মহকুমার বিশিষ্ট কবি ও যাত্রাভিনেতা অনুপ ভট্টাচার্য জানচলেন মহামায়া টকিজে সিনেমা দেখার স্মৃতি—" মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম 'অমানুষ' সিনেমা দেখতে। তখন আমি ছোট মারপিটের দৃশ্যে মাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করি। পরে ওই সিনেমাহলে দেখেছি 'শ্যাম সাহের' সিনেমা"।
'মহামায়া ' সিনেমাহল বন্ধের পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। বঙ্কিম বাবু বলেন," গ্রামগঞ্জে মিনি পর্দার ভিডিওহল চালু হওয়া যেমন একটা কারণ,একইসাথে লাইসেন্স রিন্যুয়াল ফিশ,এন্টারটেইনমেন্ট ট্যাক্স,ছবিরে দর তার উপরে দর্শকের ভিড় কমতে থাকা ইত্যাদির কারণে একসময়ে লসে রান করতে থাকে। বাধ্য হয়ে সিনেমাহল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়"। অনুমান ১৯৮৫ সাল নাগাদ মহামায়া সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। তবে 'মহামায়া' সিনেমাহলের প্রসঙ্গ উঠলে শুধু বঙ্কিম প্যোড়া নয় কল্মীজোড় পার্শ্ববর্তী মানুষ আজও স্মৃতির সরণী বেয়ে পৌঁছে যান সেইদিনে আর প্রগলভ হন মহামায়ার স্মৃতিচারণায়।
তথ্যঋণঃ–
শ্রী বঙ্কিম প্যোড়া - খাড় রাধাকৃষ্ণপুর
শ্রী অশোক গোস্বামী– কাদিলপুর
শ্রী অনুপ ভট্টাচার্য – কাদিলপুর
…………………………
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
No comments:
Post a Comment