রবীন্দ্র পরম্পরা
পর্ব - ৩৬
আলোর আড়ালে
মহাশ্বেতা দাস
"আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে "
নিজস্ব প্রতিভা কম ছিলো না। তবু শুধুমাত্র "বাবামশায়ের" ইচ্ছে পূরণের লক্ষ্যে যে মানুষটি জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নয় "রথি" .... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মৃণালিনী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান জৈষ্ঠ্য পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিশ্বকবির রবি কিরণের আড়ালে রথীন্দ্রনাথের প্রদীপের নীচে অন্ধকারের সমতুল্য জীবন পলে পলে মহাভারতের কর্ণের কথা মনে করিয়ে দেয়।
শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় যে পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে তার পথ চলা শুরু করেছিল রথীন্দ্রনাথ তাদের মধ্যে অন্যতম। রথি'র প্রাথমিক শিক্ষা শান্তিনিকেতনের মাটিতে এভাবেই শুরু হয়েছিল। তারপর বাবামশায়ের ইচ্ছেতেই আর্বানায় ইলিনয়ের স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কৃষি বিজ্ঞানে বি. এস হয়ে দেশে ফিরে আসা। বিদেশে থাকা কালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে ছেলেকে লিখলেন - " আমাদের দেশের হাওয়ায় কী চাষা কী ভদ্রলোক কোনমতে সমবেত হতে জানে না। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতি গতি যদি ফেরাতে পারিস তো দেখা যাবে।"
ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজনন শাস্ত্র শুনতেন খুব মন দিয়ে। রথীন্দ্রনাথের কথায় - " সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনও ঘটে নি।"
এবার রথি'র জীবনে নেমে এলো বাবামশায়ের ইচ্ছে পূরণের আর এক কঠিনতম পরীক্ষা। ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেতেই রথীন্দ্রনাথ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন প্রতিমা দেবীর সাথে। অবনীন্দ্রনাথ এবং গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনয়িনী দেবী ও শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে ছিলেন প্রতিমা দেবী । রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছোট প্রতিমাকে দেখে তাকে নিজের পুত্রবধূ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন একসময়। কিন্তু মৃণালিনী দেবীর অকালমৃত্যুর ফলে তা সম্ভব হয়নি। জীবন তো থেমে থাকে না! তাই মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রতিমার বিয়ে হয়ে গেল গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের সাথে। কিন্তু নিয়তির অমোঘ লীলা ঠেকায় কে?..... বিয়ের অল্পকিছুদিনের মধ্যেই গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হল নীলানাথের। পাঁচ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথের সাথে প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। এর আগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সমাজ সংস্কারকে অগ্রাহ্য করে অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বটে। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে সুজাতা কে ব্লাউজ/সেমিজ পরিয়ে বিয়ের আসরে বসানো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন সৌদামিনী দেবী বেথুন স্কুলে পড়তে গেলে তৎকালীন কবি ঈশ্বর গুপ্ত ছড়া লিখলেন-
" যত ছুঁড়ি গুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে।
তখন এ. বি শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে।"
স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দীপ্তিমান নারী, বাংলা সাহিত্যের সার্থক লেখিকা। মহর্ষি তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন - " স্বর্ণ তোমার লেখনীতে পুষ্প বৃষ্টি হউক।"
লেখালেখির পাশাপশি তিনি বিধবা বিবাহ ও নারীকল্যাণমূলক কাজ করার মানসে "সখি সমিতি" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আর ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এবং কাদম্বরী দেবী সম্পর্কে তো আগেই বলেছি আবার বলবো প্রসঙ্গ ক্রমে।
সে যাইহোক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হয়েও নিষ্ঠার সঙ্গে হিন্দু ধর্মের সংস্কার মেনে চলতেন। তাই বিবাহের পরিকল্পনায় সেভাবে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর আগে দেখা যায় নি ঠাকুরবাড়িতে।
সেদিক থেকে উল্লেখ্য রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীর বিয়ে ছিল ঠাকুর বাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ।
বাবামশায়ের নির্দেশেই রথীন্দ্রনাথ শিলাইদহের পতিসরে তৈরী করিয়েছিলেন মাটি পরীক্ষার গবেষণাগার। বিদেশ থেকে আমদানি করেছিলেন ভুট্টা আর গৃহপালিতপশুদের আহারের জন্য ঘাসের বীজ। তৈরী করিয়েছিলেন লাঙল,ফলা, নানা যন্ত্রপাতি। আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর কাছ থেকে পতিসরের জন্য চেয়ে এনেছিলেন ট্রাক্টর যা নিজেই চালাতেন। পুরোদমে চলছে যখন এই কর্মযজ্ঞ এবং নতুন দাম্পত্য জীবন…. ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী গড়ে তোলার লক্ষ্যে একা হিমশিম খাচ্ছেন ! তাই ডেকে পাঠালেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ কে। বাবামশায় কে সর্বদিক দিয়ে সুখী করাই যাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত তাঁর কাছে এ আর নতুন কথা কী!! .... আবার পিতার লক্ষ্য পূরণে তাই আহুতি দিলেন নিজের সর্বস্ব।
১৯২২ সালে প্রতিমা দেবী আর রথীন্দ্রনাথের মাঝে বাবামশায়ের ইচ্ছেতেই আবার এলো পালিতা কন্যা নন্দিনী, দাদামশায়ের আদরের "পুপে "।
"যদি আরও কারে ভালবাস
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো।"
সব ঠিকঠাকই চলছিল। কাল হল অতি সাহসী বন্ধুত্বে। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন রথীন্দ্রনাথ এক অপ্রতিরোধ্য প্রেমের সম্পর্কে। এক অসম্ভব দাবী করে বসলেন…. বন্ধু নির্মলচন্দ্রের কাছে চেয়ে নিলেন প্রায় ৩৬ বছরের ছোট মীরা কে। প্রথাভাঙা অন্তরঙ্গতার দরুণ প্রতিমা দেবী কে রেখে মীরাকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন দেরাদুন। যাওয়ার সময় প্রতিমা দেবী কে বললেন- "লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না। এখানে সবাই কে জানিয়ে যাচ্ছি। মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।"
এরপর প্রতিমা দেবীর আর কী বা বলার থাকতে পারে!! দাম্পত্যে একাকীত্ব যেন প্রতিমা দেবীর ললাট লিখন। শিল্পীদের সাধনার জন্য জীবন না কি তাঁদের একাকীত্ব আর বিষাদ উপহার দেয়! প্রতিমা দেবী নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে। অভিমানের আগুন কখনও প্রতিমা দেবীর কাজের পথে বাধা হতে পারে নি।
পত্র মারফৎ কুশল বিনিময় হতো রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমা দেবীর মধ্যে। যদিও রথীন্দ্রনাথ তখন সমগ্র মন নিয়েই অন্য কারো। সময়ের স্রোত সব আবেগ সব যন্ত্রণা মুছে দেয়। রয়ে যায় কর্মের কোলাহল। তাই শান্তিনিকেতনের সৃষ্টিকর্মেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেন প্রতিমা দেবী। আর স্বামী রথীন্দ্রনাথ কে লিখলেন -
" ভালো আছ এই খবর পেলেই খুশী হব।"
………………………….
সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল
সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা
প্রচ্ছদ ভাবনা - মহাশ্বেতা দাস
কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪
চমৎকার রচনা।
ReplyDelete