Sunday, 29 December 2024

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

 



আমি এক নদী

অমৃত মাইতি


আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার দিকে। আমার সিদ্ধান্ত নির্ভুল। বাধা পেয়ে আমি বিচলিত হই না। অনতিক্রম্য হলে আমি আমার পথ ঘুরিয়ে নিই লক্ষ্যবস্তু কিন্তু ঠিক থাকে। চলার পথে আমার কৌশল বদলাতে হয়। কিন্তু মোহনায় যাওয়ার স্থির সিদ্ধান্ত আমি বদলাই না। বাধা পেলে আটকে যাই না। কৌশল বদলাই ঠিকই কিন্তু কৌশলটা আমার শেষ কথা নয়। আমার শেষ কথা মোহনায় যাওয়া। আঁকাবাঁকা পথে মনে হয় আমি বোধহয় কোথাও হারিয়ে গেছি। কিন্তু না। আমার সঙ্গে এগোতে থাকো দেখবে আবার বাঁক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে। চপলমতি মানুষ আমাকে ভুল বুঝতে পারে। বাঁক নেওয়ার সময় মনে  হতে পারে আমি হারিয়ে গেছি। পরক্ষণে তুমি দেখবে তোমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার জন্য জন্মাইনি। নদীর স্থবিরতা তার কলঙ্কময় জীবন। গতিময় নদী তার বৈশিষ্ট্যকে ধরে রাখে। সে কিছুতেই শ্যাওলা জমতে দেয় না তার দেহে। শ্যাওলা জমে যাওয়া তার সৃষ্টির অসম্মান। শ্যাওলা শরীরকে অসুস্থ করে দেয়। তার গতিপথ সমাজদেহ ভূমিপৃষ্ঠ তার বক্ষস্থল । তার অবলম্বন। বালি মাটি কাঁকর পাথর ভাঙ্গা নুড়ি নদীর অলংকার। নদীর দুই পাড়ে সবুজ বনানী জনপদ জনতার আদালত তার পাহারাদার। আমি এমনি এক নদী কখনো আমার ভাঙ্গনের রুপ দেখে মানুষ মনে করে এই বুঝি নদী হারিয়ে গেল অন্য পথে। সজাগ জনপদ সজাগ জনতা ঠিক আমার পাশে সতর্ক প্রহরার মতো আমাকে সঠিক রাস্তায় প্রবাহিত করার শত চেষ্টা তাদের। কত অন্ধকার রাত্রি নক্ষত্র তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। বেগবতী নদী সব দেখে। নদীর নির্ঘুম রাত কাটে অমাবস্যার সৌন্দর্য আর তার শরীরের ঢেউ গুনতে গুনতে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস আর ভাটিয়ালি সুরে মাঝির গান নদীকে পাগল করে দেয়। নদী যেন নান্দনিক তত্ত্বের জন্মদাত্রী। বুড়িগঙ্গা থেকে বরিশালের পথে লঞ্চের ডেকে বসে বসে রাতের গঙ্গার মোহিনী রূপ আর দুই তীরের অপরূপ রূপে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। নিজেরই অজান্তে কখনো নদী হয়ে যাই । মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা  সত্যিই যদি নদী হয়ে যায় তাহলে এক আদর্শ জীবনের খোঁজ পাই।নদীকে অস্বীকার করে না কেউ ,যদিও সে হারিয়ে যায় মোহনায় । কিন্তু উৎসকে অস্বীকার করা মুর্খামি এবং স্থূল-বুদ্ধির পরিচয়ক। মোহনাও জানে তার সমস্ত নির্জনতা নদীর সঙ্গমস্থল। আমি এখন মোহনায় যাব সেখানে কি সীমাহীন নির্জনতা। মোহনা আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। মোহনা আমাকে ডাকছে তার সীমাহীন সৌন্দর্য আর নির্জনতায় ভরিয়ে দিবে আমাকে। জীবনানন্দ তখন আমাকে কানে কানে বলে,"তুমি জল, তুমি ঢেউ -সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন /তোমার দেহের বেগ তোমার সহজ মন/ভেসে যায় সাগরের জলে আবেগে"।

সেদিন রাতের অন্ধকারে জল আর ঢেউ ভালবেসে লঞ্চে উঠেছিলাম।"তোমাকে কে ভালবাসে,তোমারে কি কেউ/বুকে ধরে রাখে/জলের আবেগে তুমি চলে যাও/জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধুধু জল তোমারে যে ডাকে/। আমি তখন তাকিয়ে বরিশালের দিকে। হয়তো বরিশালও আমার দিকে তাকিয়ে আছে আপ্যায়নের জন্য।যেন " নিশীথের বাতাসের মতো/একদিন এসেছিলে,/দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পারি যত"/কেবিনে গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করি।"ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে"।"ওইদিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর"। আদিম রাত্রির ঘ্রাণ/বুকে লয়ে অন্ধকারে গাহিতেছে গান"। ইচ্ছে তো জাগেই নদী হয়ে যেতে।"ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে ধীরে পৌষের রাতে-কোনদিন জাগবো না আর/কোনদিন জাগবো না আমি কোনদিন আর"।

আমিও মনে করি আমি নদীর মত। আমিও নদী ভালবেসে তার জল আর ঢেউ ভালোবেসে নিজের শরীরটাকে ভেঙ্গে চুরে তার সমস্ত গুণাবলী গায়ে মেখে নিয়ে নদী হয়ে যাই।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Sunday, 22 December 2024

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ২০৭

 


শীতকাতুরে

অমৃত মাইতি 

এক.

শীতকাল কেন যে ভালো আমি জানিনা। আমার তো ভীষণ কষ্ট হয়। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভ্য়ে সারাক্ষণ জড়োসড়ো হয়ে গরম জামা কাপড় গায়ে দিয়ে কুঁকড়ে কুঁকড়ে থাকা। দিন ছোট রাত বড়। কাজের সময় কম। শীত আর কুয়াশার কারণে মর্নিং ওয়াক করা বারণ। তারপরে আমার মত বৃদ্ধের কি ভীষণ কষ্ট বোঝাতে পারবো না। হাত-পা শরীরের চামড়া রক্ষা করার জন্য ক্রিম মাখা। ভালো করে চান করার সুযোগ কম। ভোর হয় দেরি করে আবার সন্ধ্যা হয় তাড়াতাড়ি। কেন যে শীতকাল ভালো আমি জানিনা। না বুড়ো হয়ে গেছি বলে নয় আমার কোনদিনই শীতকাল ভালো লাগেনা। কতটুকু সময় পাওয়া যায় কাজের! শীতকালে অবশ্য ভালো ভালো খাওয়ার পাওয়া যায়। ডাল ফুল কফি সিম বড়ি খেজুর গুড এইসব শীতেই ভালো। হরেক রকমের পিঠে পুলি খাওয়ার লোভে আমার ভাই এই অসহ্য কষ্টকর শীত চাই না।আর এখন তো সারা ঋতুতেই সব রকম সবজি পাওয়া যায,। তবে ছোটবেলায় শীতটা ভালো লাগতো। বেশ মজা লাগতো বাড়ির সামনে খড় জ্বেলে গা সেঁকা। তারপর ঝমঝম কুয়াশায় ঘটি হাতে খেজুর গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা । খেজুর রস খাওয়ার জন্য শিউলিকে অনুরোধ করা। রাত্রিবেলা শালুক ডাঁটা খেজুর রসের কলসির মধ্যে দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে রস খাওয়া বেশ মজার ব্যাপার। এসবের প্রতিযোগিতাও ছিল। তারপর দিনের বেলা মাঠের নাড়া ছিঁড়ে এক জায়গায় জড়ো করে রাখতাম। সন্ধ্যার পরে আলু বেগুন কচু পোড়া আর শীতপতিরোধ করার মধ্যে বেশ আনন্দ ছিল। শীত মনে হতো না। আসলে শীত প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল।এখন এই বার্ধক্যে লেপ-কম্বল শ্রেয়। শীত উপভোগ করার জন্য আর কষ্ট করা যাবে না। এখন ওই শীতকাল নিয়ে গল্প কবিতা লেখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে হতে পারে। কবে যে এই কনকনে ঠান্ডাটা যাবে! একটু গায়ে আলো বাতাস লাগিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারবো ,! মাঘ মাস  কবে আসবে।তারপর আসবে 'মাঘের আধে কম্বল কাঁধে খনার বচন বলতে পারব।তারপর বলব যাক এবার শীত যাবে শিবের ঝুলিতে। আর ভালো লাগছে না শীত,। শীতের কোন আদর্শ বোধ নেই। আমার নিজেরই শীত শরীর। অন্যকে উত্তাপ দেবো কি করে!


দুই.

হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি আমি খুব শীতকাতুরে। কিন্তু তাই বলে শীতকে আমন্ত্রণ জানাবো না তাই কখনো হয়? 

মৃত্যুকেও তো আলিঙ্গন করতে হয়। যেহেতু কোন উপায় থাকে না। তখন বলি "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান"। রাধার একমাত্র টার্গেট শ্যাম। আমাদেরও টার্গেট মৃত্যু। বোঝার সুবিধার জন্য এই উপমা আমরা ব্যবহার করি। প্রতিটি ঋতুকে আমাদের প্রয়োজন হয় তাই আমন্ত্রণ জানাতেই হয়। প্রতিটি ঋতুর  ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রতিভাত হয় আমাদের সামনে। প্রতিটি ঋতুই আমাদের কাছে প্রিয়। প্রতিটি ঋতু সেই সময়কালে আমাদেরকে মুগ্ধ করে ।আমাদের প্রয়োজন মিটায়।

শীতকাতুরে বলে শীতকে কাছে ডাকবো না তা কি করে হয়। শীত নিয়ে আসে আমাদের বাঁচার রসদ । আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস শীতকালে সংগ্রহ করতে হয়।যার ঘরে রুম হিটার আছে এবং বাথরুমে গ্রীজার আছে প্রবল শীতেও তাদের শীতের আমেজ অনুভব করার সুযোগ হয়। আবার গ্রীষ্মে এয়ার কন্ডিশন যাদের থাকে তাদের গরমে কষ্ট হয় না। প্রবল ঠান্ডায় রুম হিটার থাকলে শীতের সুখ অনুভব করতে পারে। আমার মত শীতকাতুরের যদি এসব সুযোগ না থাকে তাহলে সে শীতকেই ভয় পায়। আসলে শীতে ভীষণ কষ্ট হয়। কখন সূর্য উঠবে উত্তাপ গায়ে মেখে নিতে পারবে সেই অপেক্ষায় রাত কাটে কত মানুষের। আবার শীতের এক অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য শীতভোরে আমরা দেখে মুগ্ধ হই। কবিরা কবিতা লিখে। লেখকরা সে রূপের বর্ণনা দেয়। 

সোনালী ধানের ক্ষেত। শিশির সিক্ত ধানের শীষ। ধানের শীষে শিশির সোনালী রোদে চিকচিক করে। একদিকে ফসলের প্রতি আমাদের মোহ এবং পাশাপাশি তার অপার সৌন্দর্য কনকনে ঠান্ডাতেও আমাদের মনকে রাঙিয়ে দেয়।তখন স্বভাব শীতকাতুরে মানুষটি গেয়ে ওঠে "ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" শীতের এক অদ্ভুত আকর্ষনীয় ক্ষমতা আছে। শীত এবং প্রকৃতির অপরূপ রূপ দেখে মানুষের মনে যে আবেগ সঞ্চারিত হয় তা কবিগুরু সঠিকভাবেই তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন।

"শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে"। পূবের লাল টকটকে সূর্য নিথর প্রকৃতির কোলে যে লাবণ্য তৈরি করে তা দেখার সৌভাগ্য যারা শীতকাতুরে তাদের হয় না। আমি শীতকাতুরে ঠিকই কিন্তু শীত ভরে লাবণ্য অবলোকন করার জন্য ঝুঁকি তো নিতেই হয়।

শীত ভোরে কনকনে ঠান্ডায় যখন অন্নদাতাদের আঙুলগুলো বেঁকে যায় ধান কাটার সময় অথবা ধানের আঁটি বাঁধার সময় তখন একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে দেখা এবং সহানুভূতি প্রদর্শন করা শুধু নয় নিজেকে তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগকে কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। সরষে ক্ষেতের হলুদ রাঙা ফুল কার না মন টানে! হরেক রকমের সবজি বাগানের আবেগের ফসল। ধান সবজি গম সরষে ক্ষেত এসবই তো শীতের ফসল। আহা বলতে বলতে জিভে জল এসে গেল। এই শীতে কচু পালং শাক কলাই শাক মুলো সিম বিট গাজর দেশি বড়ী নকশা বড়ি ইত্যাদি। শীতকালে ধান জমি থেকে পাওয়া যায় চুনো পুটি ল্যাঠা শোল কৈ সিঙ্গি মাগুর মৌরালা।এই শীতেই তো পাওয়া যায়। এই শীতের সময় মাঠের জল যখন খাল নালার দিকে চলে যেত গড়িয়ে তার সঙ্গে প্রচুর পুঁটি মাছ ছোট ছোট ল্যাঠা মাছ গুলে মাছ চিংড়ি মাছ বাঁকিতে (মাছ ধরার একরকম সরঞ্জাম) আমরা ধরতাম। এগুলো এত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত টাটকা  মাছ খাওয়ার পরেও বাড়তি কিছু শুকিয়ে রাখা হতো। আমরাই সুখা মাছ ভেজে অথবা পুড়ে শীত ভোরে রোদে বসে বসে খেতাম। কি অসাধারণ টেস্ট । তাইতো মাঝে মাঝে মনে হয়, আবার শীতকাল কবে আসবে।কখনো কখনো  বাড়িতে বেগুন দিয়ে চচ্চড়ি হতো। ভাবলেই জিভে জল চলে আসে। শীতে যতই জুবু থুবু হয়ে থাকি না কেন সকালে হালকা রোদে উঠনে বসে এই মজার খাবার আর সঙ্গে থাকতো বড়ি পোড়া। উত্তরের গা হিম করা শীতের বাতাসক পাত্তা দিতাম না। মা গুড় পাক করে মুড়ি মিশিয়ে মোয়া করতেন। শীতের রোদ গায়ে লাগিয়ে বসে বসে কামড়ে কামড়ে খেতাম। এ তো শীতকালেই সম্ভব। শীতের পদধ্বনি শুনলেই সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যতই শীতে কষ্ট পাই না কেন আমি তো জিভের জল সামলাতে পারিনা। কি করব লোভী মানুষ। আমাদের যে সবকিছুই চাই। গ্রীষ্ম চাই বর্ষা চাই শীত চাই সবটাই চাই।


 শীতকাল ভোজন রসিকদের জন্যই উপযুক্ত।তাই শীত ঋতু না হলে মানুষবা বাঁচবে কি করে! তাই শীতের কষ্টটা কিন্তু আমাদেরই প্রয়োজনে সহ্য হয়ে যায় কারণ অন্নদাতারা আমাদের মুখে খাবার তুলে দেয়। তাই শীত ঋতুর গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা অকপটে মেনে নিতে হয়।  তাই শীত যতই কষ্টকর কঠিন হোক না কেন প্রকৃতির প্রেমে তন্ময় কবিগুরুর সাথে গাইতে হয়।"শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে ব'লে; শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে"। সারারাত জেগে জেগে মাটির পরে শিউলির বিছানা দেখে ছুটে যাই কুড়িয়ে নিই দুহাত ভ'রে ।মাটির 'পরে শিউলির বিছানার টানে ভোর ভোর উঠে পড়ি শীতকে অগ্রাহ্য করে। কবিগুরু যেন শীতের  সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন।"পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয় আয় আয় "। শীত কালকে দুহাত বাড়িয়ে যারা আলিঙ্গনে আবদ্ধ করতে চায়, আমন্ত্রণ জানায় তাদের কাছে এবং সমগ্র সমাজের কাছে শীতের এক অপরিসীম ক্ষমতা রয়েছে। তাই আমি শীতকাতুরে একজন মানুষ বাধ্য হলাম শীতকে স্বাগত জানাতে। এই ক্ষেত্রে আমি হয়তো একটু প্রাচীনপন্থী কিন্তু শীত উদারপন্থী। তাই শীতের গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সবশেষে বলি শীতকালে সবজি চাষিরা অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। গ্রাম থেকে শহরের দিকে ব্যাপক হারে সবজি ব্যবসায়ীরা ম্যাটাডোর লরি ভর্তি করে নিয়ে যায়। সবজি চাষের ফলে শ্রম দিবসও সৃষ্টি হয়। পুনরায় চিত ঋতুকে স্বাগত জানাই জনস্বার্থে।

                          ……………………….. 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Sunday, 8 December 2024

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ২০৬

 



একজন প্রবীণ ব্যক্তি পুস্তকের সমান

অমৃত মাইতি 


একজন প্রবীণ ব্যক্তি পুস্তকের সমান ।এই অভিমত আমার ব্যক্তিগত। আমি সবসময় সদর্থক চিন্তা ভাবনার মানুষ। মানুষ মানুষকে দিতে পারে। সমাজকেও দিতে পারে। তবে সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে সবকিছু। যদি মনে করেন সমাজের জন্য তিনি উৎসর্গীকৃত। তাহলে তিনি সময় ও সমাজের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন।

মানুষের মধ্যে জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি এই দুইয়ের সমাহার রয়েছে। সব মানুষের মধ্যে জীববৃত্তি আছে। আমি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি না। আমি যে ধরনের আলোচনার সূত্রপাত করেছি সেই ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি মূল বিষয়বস্তু। একটি শিশু তার জৈবিক এবং শারীরিক বৃদ্ধি

বুঝতে পারে। সে দিনে দিনে বড় হচ্ছে। প্রতিটি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আছে। সামাজিক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধির বিকাশ বাইরের দিক থেকে বোঝা যায় না। কিন্তু শারীরিক বিকাশ বোঝা যায়। মানুষের বুদ্ধাংক সমান নয়।

আই কিউ বা ইন্টেলিজেন্স কুইটেন্ট পরিমাপের পদ্ধতি আছে। মনোবিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে এই বিষয় একটি জরুরী সিলেবাস। মানুষের যত বয়স বাড়ে তার বুদ্ধি বৃত্তি এবং বুদ্ধাংক বাড়তে থাকে। এইসব ব্যবহারিক জীবনের বিকাশ। বয়স বাড়লে বুদ্ধি বাড়ে বা বুদ্ধাংক গভীর হয় 

একথা সবসময় খাটেনা। বুদ্ধাঙ্ক তীক্ষ হলেই তিনি মানবিক হবেন তিনি শিক্ষিত হবেন, জ্ঞানী হবেন এমন কোন কথা নেই। তাঁর জীবন যাপনের ব্যবহারিক দিক যদি খুব খাটো হয় বা ছোট হয়, তাঁর কাছ থেকে বড় কিছু আশা করা যাবে না এবং তিনি অন্য কোন মানুষকে পথ দেখাতে বা আলো দিতে পারবেন না। যদি তিনি আকাশের মত উদার হন তাহলে তিনি সামাজিক বহু ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মানুষের পরিচয় দিতে পারবেন। তাঁর জীবন শিক্ষণীয় এবং গ্রহণীয় হবে। তিনিও একটি বইয়ের মত সমাজের কাছে হয়ে উঠবেন।তোতা পাখির মতো পড়াশোনা করেও বুদ্ধি বাড়তে দেখা যায়নি বা বিচক্ষণতা  দেখা যায়নি। বয়সের তুলনায় অনেক কম হলেও , বুদ্ধাংক অনেকের চাইতে যথেষ্ট বেশি দেখা যায়।। তা সত্ত্বেও যদি ধরে নেওয়া যায় বয়স যত বাড়ে, মানুষ বয়সে যত প্রবীণ হয় তত জ্ঞান অভিজ্ঞতা বুদ্ধাংক বাড়ে। একজন প্রবীণ ব্যক্তির সারা জীবনের জ্ঞান অর্জন বিদ্যা বুদ্ধি সামাজিকতা ব্যবহারিক জ্ঞান সমাজ চেতনা সবকিছুই প্রণতা পায়।বহু বিষয়ে একজন প্রবীণ মানুষের পরিপূর্ণতা দেখা যায়। তখন তিনি একজন পুস্তক। অবশ্য একজন স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন প্রবীণের কাছ থেকে তেমন কিছু আশা করা যাবে না ,যা আপনাকে জ্ঞানী করে তুলতে পারে।একজন প্রবীণ ব্যক্তির সমস্ত গুণাবলী একটি ভরা পুকুরের মতো। পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি বই বিক্রি হয় কার্ল মার্কসের। তাঁর জীবনটাই একটি পুস্তক। রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র মাইকেল বিবেকানন্দ বঙ্কিমচন্দ্র জীবনানন্দ নজরুল সুকান্ত

এবং দেশে-বিদেশে সমস্ত মনীষীরা কিন্তু এক একজন এক একটি পুস্তক। তাঁদের জীবনের নির্যাস তাঁদেরই রচিত বই। শৈশব থেকে উদার মনের মানুষরা সমাজকে যেভাবে দেখেছেন তার প্রতিফলন পুস্তকের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং পুরো জীবনটা অভিজ্ঞতালব্ধ। তাই আমার মনে হয়েছে একজন প্রবীণ মানুষ একটি পুস্তকের সমান। একটি পুস্তক পড়ে আমরা জ্ঞানী হই। আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ে। বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারি। তখন আমরা সমাজকে নানান ভাবে আলোকিত করার চেষ্টা করতে পারি। পুস্তক আমাদের বন্ধু দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। ঠিক তেমনি মনীষীরা এমনকি অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ জ্ঞানী প্রবীণ ব্যক্তিরাও আমাদের বন্ধু দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজকে, অজ্ঞ মূর্খ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন মনীষীরা আর তাঁদের চেতনাকে বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে পুস্তকের বিরাট অবদান। প্রবীণ মানুষ আমাদের অভিভাবক এবং পুস্তকও আমাদের অভিভাবক। একজন প্রবীণ মানুষ সাধারণ অজ্ঞ মানুষের অশিক্ষা কুশিক্ষার সুযোগ নিয়ে কুসংস্কারে  আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে; আবার পাশাপাশি সেই প্রবীণ মানুষ জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিতে পারে। তাঁদের জন্ম অন্ধ জনের আলো দেওয়ার জন্য। তাঁরা সমাজের বুকে জনজাগরণের ঢেউ তুলতে পারে। বর্তমানে সমাজের মধ্যে যেভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামি 

মৌলবাদ মাথা চাড়া দিচ্ছে আর একটা রেনেসাঁসের প্রয়োজন হয়েছে।  ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কার জাগরণের পথপ্রদর্শক হিসেবে পুস্তক এবং প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে পুনর্জাগরণের পথ দেখাতে পারে।প্রবীণরাইতো বলবেন নবীদেরকে"ওঠো জাগো"। সময় হয়েছে মনের দরজা খোলো। পুস্তক খুলে দেখো ইতিহাস তৈরী করতে হবে মানুষকেই । সমস্ত জাগরণের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে পুস্তকে। একজন সংস্কার মুক্ত সচেতন ধর্মনিরপেক্ষ প্রবীণ মানুষ পুস্তকের সমান। 

শুধু বয়সে প্রবীণ হলেই হবে না। সেই প্রবীণ মানুষ যদি সত্যিই একটি পুস্তক হয়ে উঠতে পারেন তাহলে আমরা একটা নতুন যুগের সৃষ্টির ছবি আঁকতে পারবো। প্রবীণ নবীন উভয়কেই শক্ত করে হাত ধরে এই পচা গলা সমাজের হাল ধরতে হবে। গাইতে হবে রানারের গান।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Sunday, 1 December 2024

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ২০৫

 



তর্ক না আলোচনা - অমৃত মাইতি 

আগে ঠিক করে নিতে হবে তর্ক করব না আলোচনা করব। তর্ক করে সময় নষ্ট করব না আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসব। দুজন অভিজ্ঞ মানুষ কোন বিষয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু সম্পর্কে উভয়ের সম্যক জ্ঞান থাকা চাই। ভালো তার্কিক হলে তর্ক করা যায়। তর্কের নিয়ম রীতি মেনে তর্ক করলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ। সাধারণত এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে তর্কযুদ্ধ বলা যায় না। আলোচনা বলা যেতে পারে। আমরা অনেক সময় তর্কে অবতরণ করি। কারুর না কারুর যদি জ্ঞানের ঘাটতি থাকে এবং যদি তার নিয়ম রীতি সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকে তাহলে সেই তর্ক কোনদিন থামবে না। দুজনে যদি বুদ্ধিমান মানুষ হন যদি প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মানসিকতা নিয়ে বসেন তাহলে কোন একজন নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন এবার থামা উচিত। একটি কথা প্রচলন আছে"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর"। প্রকৃত তার্কিক যারা কোথায় থামতে হবে সেটুকু জ্ঞান তাদের আছে। তর্কের মধ্য দিয়েও জ্ঞানের আদান প্রদান জ্ঞানের গভীরতা নির্ণয় হয়। আসলে সবকিছু নির্ভর করে তার্কিকদের মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার উপর। পাশাপাশি কোন এক পক্ষ যদি মূর্খ অবিবেচক হয় এবং একগুঁয়ে প্রকৃতির হয় তাহলে তার সঙ্গে তর্ক করা বা আলোচনা করা একেবারেই উচিত নয়। অনেকে তর্ক বা আলোচনার আগে থেকেই ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত করে নিয়ে বসেন। তাকে আপনি যতই সহজ সরল ভাষায় যুক্তি দেখান না কেন সে কিছুতেই মানবে না।

পরাজয় স্বীকার করতে তাঁর ইগোতে বাধে। সিদ্ধান্ত গ্রহণটা তাদের কাছে বড় নয়, তাদের কাছে বড়  হলো নিজের ভুল চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজের পক্ষে কথা বলা। হেরে গেলেও সঠিক যুক্তিপূর্ণ কথা বা সিদ্ধান্ত তিনি মানবেন না। অনেক সময় বিপত্তি ঘটে উভয়ের জ্ঞান মানসিকতা চিন্তাধারার যদি গরমিল হয়। আলোচনা বা তর্কে বসার আগে মনটাকে যুক্তিবাদী করে নিতে হয়। অনেক সময় গোঁড়া মতবাদের বা কোন প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণার বিশ্বাসী মানুষ কিছুতেই তার মানসিক অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইবে না। যেমন কুসংস্কার একবার ঢুকে গেলে তার মাথা থেকে বের করা কঠিন। সে কোন যুক্তি মানে না তর্ক মানে না কোন আলোচনা মানে না। মান্ধাত্তার আমলের ভ্রান্ত ধারণাকে আঁকড়ে বসে থাকবে সে। সাপের কামড়ের তীব্র বিষ শরীর থেকে বের করা যাবে কিন্তু এদের মন থেকে কুসংস্কার বের করা যাবে না। মন্দিরের চারপাশে দন্ডি মাপা মেয়েদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে দেখেছি সে আপনার কথা মন দিয়ে শুনছে কিন্তু তার মনের ধারণাকে কিছুতেই  বিসর্জন দিতে পারছে না। তর্ক বা আলোচনা যাই করি না কেন অনেক সময় সামাজিক অবস্থানের উপর কিন্তু নির্ভর করে। সামাজিক কু -প্রথা ও মন্দ প্রভাব থেকে মনকে যদ মুক্ত করতে না পারা যায় তাহলে তাদের সঙ্গে তর্ক করে পারা যাবে না। এই সমস্ত মানুষরা এক জোট বেঁধে আপনাকে বিব্রত করে  আপনাকেই মূর্খ বানিয়ে দিবে।

তর্কবিদ্যা না পড়েও অনেকে ভালো তর্ক করতে পারে।

সেক্ষেত্রে কিন্তু পদে পদে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যারা তর্কবিদ্যা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করার পরে তর্কে অবতরণ করেন তাদের ভুলের সম্ভাবনা কম থাকে। একজন ভালো তার্কিক এবং আলোচক তার জ্ঞানের কারণেই নম্র বিনয়ী হয়। তাদের সঙ্গে যে কোন বিষয়ে তর্ক করা বা আলোচনা করা যুক্তিসঙ্গত। আপনারও জ্ঞান বাড়ে তাঁরও আপনার কাছ থেকে কিছু নেওয়ার থাকে। সর্বোপরি যুক্তি-তর্ক আলোচনা আমাদেরকেই সমৃদ্ধ করে। আমি দেখেছি অজ্ঞ মূর্খ গোঁয়ার লোকদের সঙ্গে এমনি সামাজিক সম্পর্ক রাখা ভালো কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনরূপ ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে কথা বলা ভালো নয়। কখন প্রয়োজন ছড়া সে আপনার সঙ্গে কথা বলবে না। সে আপনার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে। কারণ আপনি তার মনের মত কথা বলতে পারছেন না।বরং সামাজিক সম্পর্ক নিবিড় করার মধ্য দিয়ে যদি তাকে কাছে টানতে পারেন, আমার মতে হয়তো সফল হতে পারবেন কোন একদিন।


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

Sunday, 24 November 2024

লাল পাহাড়ির দেশে যা // ই-কোরাস ২০৪

 



নগরবাউল

অংশুমান কর

গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শেষের দিক। পুরুলিয়া থেকে ট্রেনে করে একটি অনুষ্ঠানের পরে একসঙ্গে ফিরছি আমি আর অরুণ চক্রবর্তী। আসানসোল থেকে ওই ট্রেনে উঠল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের আমার কিছু সহপাঠিনী। বসল আমাদের ঠিক উলটোদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অরুণদা ওদের সঙ্গে নানারকম ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে শুরু করলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। বারবার আশঙ্কা হচ্ছে, না জানি আমার বন্ধুনিরা কী মনে করবে অরুণদার এই ব্যবহারে। কিন্তু, ওরা কিছু মনে তো করলই না, বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম ওরা বেশ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে প্রাণোচ্ছল অরুণদাকে। অরুণদা ওদের দিতে শুরু করেছেন চকলেট। এমনই ছিল এই নগরবাউলের স্বভাব। চকলেটের মোড়কে নিষ্পাপ বন্ধুত্ব বিলি করে বেড়িয়েছেন সারা জীবন। লিখেছেন এমন কিছু কবিতা যা বাংলা কাব্যজগতে রয়ে যাবে নিজেদের গুণেই। কোনো কিছুকেই ভয় করতে দেখিনি অরুণদাকে। এমনকি নেশাকেও ভয় করতেন না। কী অনায়াসে লিখেছিলেন, "নেশা আমার চাকরবাকর"! আমার নানা লেখায় মাঝে মাঝেই অরুণদার কবিতার বেশ কিছু পঙ্‌‌ক্তি ব্যবহার করেছি। খবরকাগজে প্রকাশিত সেই সমস্ত লেখা পড়লেই অরুণদা ঠিক ফোন করতেন। শেষ কয়েক বছরে মাত্র এক-দুবারই দেখা হয়েছিল। কিন্তু ফোনে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। অরুণদা ছিলেন, এটাই ছিল আমাদের এক বড়ো ভরসা। ভালো লাগত এটা ভেবে যে, কবিতার রাজনীতির ক্লেদের বাইরে একজন নাগরিক বাউল বাংলা কবিতায় বেঁচে রয়েছেন এখনও। তিনি আর নেই। এই শূন্যতা পূর্ণ হওয়া কঠিন।


হেসে অরুণদা আবার এক চুমুক

আশিস মিশ্র 

'পদ্যে অনেক কান্না ঝরায়, কান্না কি খুব সোজা',

' মদ্যপ ' শব্দটির বদলে ' পদ্যপ ' বললে তো দোষমুক্ত হওয়াই যায়। একগাল হেসে অরুণদা আবার এক চুমুক দিলেন। রাত কত হল, খেয়ালই নেই। সেবার ফারাক্কায় কবিসম্মেলনে গিয়ে সুনীল করণদার ফ্ল্যাটে দু'টি রাত কীভাবে যে কেটে গেল। আমি, অরুণদা, প্রদীপ আচার্য, গৌতমদা, সুনীলদা...। সে-সময় অরুণদার একটি ফটোগ্রাফ ( নটরাজ মূর্তির আঙ্গিকে)  তুলেছিলাম। ছবিটি আর পাচ্ছি না। গান, কবিতা, আড্ডার ফাঁকে তাঁরই লেখা আওড়ে যাই এখনও-- আমি কোনো ঝঞ্ঝাটে নেই / নেশা আমার চাকর বাকর... 

কিংবা --

স্তন নিংড়ে যতই ঢালো দুধ গঙ্গাজল / শিবলিঙ্গ কাত হয় না... 

বাংলা কবিতার এমন গৃহী বাউল কবির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগের অবসান হয়ে গেল। লক্ষ মানুষের ভিড়ে যাঁর স্বরূপ চিনতে কারুরই অসুবিধে হত না। সে জয়দেব কেঁদুলি মেলা হোক, শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা হোক।  আর পকেট থেকে কোনো কবিকে চকোলেট বের করে দিতে দেখবো না! 

অরুণদা বলতেন, বুড়ো ১০ টি কবিতাই লিখবো। ৯ টি লিখেছি। ১ টি বাকি। 

সত্যিই তো -- একজন কবির ১০ টি কবিতাই পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারে। অরুণদার ক্ষেত্রে তার কিছুটা তো হয়েছে গানের ভেতর দিয়ে। 

হলদিয়া, দাঁতন, ঔরাঙ্গাবাদ, রাণাঘাট, ঝাড়গ্রাম, মেচেদা, মালদা -- তাঁর সঙ্গে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা আমার আছে। কত কথা লিখবো? 

ট্রেন ছুটছে --দীপ মুখোপাধ্যায় আমাকে গেটের কাছে টেনে নিয়ে গেল। একটা জলের বোতল আমাকে ধরিয়ে বলল, টেনে দাও। সামনের স্টেশন চুঁচুড়া --বুড়ো উঠবে। একটু পরে দরজা দিয়ে সত্যি সত্যি 

 ' অউম ' পত্রিকার সম্পাদক উঠে পড়লেন। বাইরে ঘন অন্ধকার --হাওয়া -- দৌড় -- দৌড় --অরুণদাও আর একটি বোতল টেনে দিলেন। 

আমি বললাম -- নেশা যখন বাঘ হয়ে যায় / বাঘের গলায় ঘুঙুর বাঁধি / নেশা যখন সাপ হয়ে যায় / শ্যামের বাঁশি বাজায় রাধে...অরুণদা হেসে বললেন -- কী সাঙ্ঘাতিক! 


হাতে দিলেন একটি লজেন্স

সুকান্ত সিংহ 

তারিখটা মনে আছে। ২৭জুলাই ২০১৯। হিন্দমোটর স্টেশনে নেমেছি, দেখি ১নং প্ল্যাটফর্মে তিনি। অরুণকুমার চক্রবর্তী। আগে ছবি দেখেছি অনেকবার। সামনাসামনি এই এথম। আর ওই শেষবার। এগিয়ে গিয়ে বললুম, যা সাধারণত কাউকে বলি না, আপনার একটা ছবি তুলব? হাসি মুখ। তারপর ছবি তোলা। হাতে দিলেন একটি লজেন্স। আগেও শুনেছি লজেন্স তাঁর কাছে সব সময় থাকে। আমার এক আত্মীয়ের স্কুলে এসেছিলেন একবার। তিনি তো বহুদিন তাঁর দেওয়া লজেন্সটি রেখে দিয়েছিলেন। 

'লাল পাহাড়ির দেশে যা' লেখার পিছনের গল্প কোথাও পড়েছিলুম। এই হেমন্তের দিনে তিনি হয়তো সেই দেশেই এখন লজেন্স দিতে দিতে হেঁটে চলেছেন! 


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪


Sunday, 17 November 2024

তাহমিনা শিল্পী এর গদ্য // ই-কোরাস ২০৩




অন্তরালে মায়ার খেলা
তাহমিনা শিল্পী

কারওয়ান বাজার মেট্রোস্টেশনের সিঁড়িতে তাকে দেখলাম। এটাই প্রথম দেখা,হয়ত এটাই শেষবার।উঁচু হিল জুতো পরে প্রথম হাঁটতে শেখা শিশুর মত গুটি গুটি পায়ে নামছে। মনে হল যেন সিঁড়ি গুণেগুণে নামছে। বাদামী রঙের ভেজিটেবল ডাইয়ের শাড়ির সাথে মানানসই সাজ। মাঝারি লম্বা খোলা চুল পিঠের উপর ছড়ানো। বয়স বড়জোড় কুড়ি কিংবা বাইশ। মুগ্ধনয়ন হৃদয়স্পর্শ করলো। কথা বলার ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখলাম না।

পাশ থেকে নামতে নামতে ডান কাঁধে আলতো স্পর্শ করতেই ঘুরে তাকালো। হরিণি চোখে অপার বিস্ময়! 
স্বল্প হাসিতে মুগ্ধতা প্রকাশ করে বললাম,

- অপূর্ব! প্রথম শাড়ি পরেছো?
- না,আগেও কয়েকবার পরেছি। (ইষৎ হাসিতে খুশির দোলা)
- শাড়ি উল্টো করে পরেছো তো। আঁচল উল্টো দিকে দিয়েছো।
- ওহ্, একা একা পরেছি তো। (একটু বোধহয় লজ্জা পেলো)
- ইউটিউব দেখে শিখেছো? 
-হ্যাঁ (লাজুক হাসিটা দারুণ ছিল) 
- শোন, শাড়ি সবসময় ডান দিকের কোমরে গুঁজবে। ডান হাতের দিকটা ফ্রি রাখবে। আঁচল এবং কুঁচির ভাঁজ ডান হাতের বিপরীত দিকে থাকবে। এই তিনটি পয়েন্ট মনে রাখবে। ব্যস, আর ভুল হবে না।
-কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। কোনরকম সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কার্ড পান্স করে বের হয়ে গেলাম।আর একটু জোরেশোরেই বললাম,তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে! খুব সুন্দর! 

ফুট ওভার ব্রিজের অংশটি হেঁটে এগোতে এগোতে আমিও যেন অবচেতনে পা গুণেগুণে ব্যাকগিয়ারে এগিয়ে চললাম।

আহা আমার কৈশোরকাল! প্রথমবার মায়ের পাটভাঙা শাড়ি পরে বাড়ির তিনতলার ব্যালকনিতে দাড়িয়ে থাকা।বোকা এক সাইকেল সাওয়ারি,আর শেষ বিকেলের সেই জারুল মায়া!


সম্পাদক - দুঃখানন্দ মণ্ডল

সহ সম্পাদক - শ্রীজিৎ জানা

কথা - ৯৪৩৪৪৫৩৬১৪

অমৃত মাইতি এর গদ্য // ই-কোরাস ১০৮

  আমি এক নদী অমৃত মাইতি আমি এক আঁকাবাঁকা নদী। জন্মের পর থেকেই শুধু বাধা বাধা আর  বাধা। বাধার পাহাড় বেরিয়ে আমি কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছি মোহনার ...